সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মানবসেবায় অনন্য নাম রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৮ মে ২০২৩, ০৯:২৭ এএম

শেয়ার করুন:

মানবসেবায় অনন্য নাম রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

‘৮ মে’ বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস। দিনটি সরাবিশ্বে আর্ত-মানবতার সেবায় নিয়োজিত সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা হেনরী ডুনান্টের জন্মদিন। ১৮২৮ সালের এই দিনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিন। মহান এই ব্যক্তির জন্মের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর সারা বিশ্বে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস হিসেবে উদাযাপন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘Everything we do, comes from the Heart’ যার অর্থ ‘আমরা সকল কাজ আন্তরিকভাবে করি।’

বিশ্বের ১৮৮টি দেশে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে সংস্থাটি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করছে। দেশে সংস্থাটি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসিএস) হিসেবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ নানা কাজের স্বাধীনতার পর থেকেই মানবিক সংস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সারাদেশে সংস্থাটির ৩ লাখের অধিক স্বেচ্ছাসেবক এসব মানবিক কাজ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।


বিজ্ঞাপন


সারাবিশ্বে যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকা থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত এলাকা, সবস্থানেই সরব উপস্থিতি রয়েছে সংস্থাটির। মানবতাবাদী কাজের জন্য রেড ক্রস ও ক্রিসেন্ট সোসাইটি একাধিকবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি।

রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্টের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ইতালির উত্তরাঞ্চলের সলফেরিনো নামক স্থানে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহ ও মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সূর্যোদয় থেকে সূযাস্ত পর্যন্ত ১৬ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে হতাহত হয় দুই পক্ষের অন্তত ৪০ হাজার সৈন্য। আহত সৈন্যরা বিনা চিকিৎসায় যুদ্ধক্ষেত্রেই উন্মুক্ত প্রান্তরে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। সেই সময় সুইজারল্যান্ডের এক যুবক জীন হেনরী ডুনান্ট ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে ফ্রান্সে তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী এ মর্মান্তিক করুণ ও ভয়াবহ দৃশ্য দেখে তিনি খুবই ব্যথিত হন এবং আশপাশের গ্রামবাসীদের ডেকে এনে আহতদের সেবা করেন। তাঁরাই রেড ক্রসের প্রথম স্বেচ্ছাসেবক, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মহিলা।

ডুনান্ট এই যুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকাময় স্মৃতি ও তার প্রতিকারের জন্য ১৮৬২ সালে এ মেমোরি অব সলফেরিনো নামে একটি বই রচনা করে। এ বইয়ের মাধ্যমে তিনি বিশ্ব বিবেকের কাছে এক মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। বইটির মূল কথা ছিল, ‘আমরা কি পারি না প্রতিটি দেশ এমন একটি সেবামূলক সংস্থা গঠন করতে, যারা শত্রু মিত্র নির্বিশেষে আহতদের সেবা করবে’। সে সময়ে জেনেভার সমাজ সেবাসংগঠন পাবলিক ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি সর্বপ্রথম ডুনান্টের আবেদনে সাড়া দেয় এবং ডুনান্টের স্বপ্ন বাস্তাবয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়।


বিজ্ঞাপন


red
করোনার সময় চট্টগ্রামে অসহায় মানুষের মাঝে ইফতারসামগ্রী বিতরণ করেন রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা

১৮৬৩ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি জীন হেনরী ডুনান্ট ৪ জন জেনেভাবাসীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন, যা কমিটি অব ফাইভ নামে পরিচিত। এ কমিটির নাম পরিবর্তিত হয় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি বা আইসিআরসি হয়। ১৯৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো এ কমিটি ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জেনেভায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। সম্মেলনে ডুনান্টের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা ও গৃহীত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রেড ক্রস জন্মলাভ করে।

পরবর্তীতে মুসলিম দেশগুলোর ক্রস বিষয়ক আপত্তির মুখে মুসলিম দেশগুলোর জন্য রেড ক্রিসেন্ট নামকরণ করা হয়। একইসঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর জন্য আলাদা প্রতীকও করে দেওয়া হয়। ১৯৮০ সাল থেকে সংস্থাটির প্রতীক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট। এর ৭টি মূলনীতি রয়েছে। এগুলো হলো: ১. মানবতা ২. নিরপেক্ষতা ৩. পক্ষপাতহীনতা ৪. স্বাধীনতা ৫. স্বেচ্ছামূলক সেবা ৬. একতা এবং ৭. সার্বজনীনতা।

বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্টের যাত্রা

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি একটি মানবিক সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের দ্বারা পরিচালিত। এই সংগঠনটি ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি আদেশ ২৬ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এটির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি রাখা হয়। এর সদর দফতর রাজধানী ঢাকার মগবাজার এলাকায় অবস্থিত। ৬৪ জেলায় সংস্থাটির ইউনিট রয়েছে। এছাড়া সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বাধ্যতামূলকভাবে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

১৯৭৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি আদেশে ১৯৭৩ (পিও-২৬) জারি করেন। এই আদেশের বলে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল থেকে সংস্থাটি স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রেডক্রসের ২২তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তেহরানে বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটি আন্তর্জাতিকভাবে পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও স্বাধীনতার আগে থেকেই ১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকেই এই অঞ্চলে রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রম ছিল।

বাংলাদেশে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যক্রম

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশ বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি নানা ধরনের মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতি দুর্যোগের সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, আগুনসহ মানবিক বিপর্যয়ে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ, প্রথমিক সেবা প্রদানের মতো কাজে সংস্থাটির স্বেচ্ছাসেবকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সারাদেশে রক্ত সেবা প্রদানের অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে রেড ক্রিসেন্টর স্বেচ্ছাসেবকরা। এসব কার্যক্রম সাধারণত সংস্থাটির যুব সদস্য বা স্বেচ্ছাসেবকরা করে থাকেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ন্যাশনাল ইয়ুথ কমিশনের ভাইস চেয়ার হুসাইন মুহাম্মদ প্রদীপ প্রধান ঢাকা মেইলকে বলেন, সারাদেশে প্রায় ৩ লাখ যুব সদস্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রেড ক্রিসেন্টের নানা কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিয়োজিত আছে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তাবায়নে কাজ করেছি। এর মধ্যে করোনা মহামারিকালীন কার্যক্রম, সিলেট ও সংলগ্ন হাওর অঞ্চলে বন্যায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এখনও বিগত বন্যা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে রিকোভারি প্রজেক্ট চলছে। এর আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের বাড়ি করে দেওয়া ও জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজন অনুযায়ী নগদ অর্থসহ নানা সাহায্য সহযোগিতা করা হচ্ছে।

করোনাকালীন কার্যক্রমের কথা স্মরণ করে হুসাইন মুহাম্মদ প্রদীপ বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় রেড ক্রিসেন্ট নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে করোনা বিষয়ক সতর্কবার্তা প্রচার, জীবণুনাশক স্প্রে ছিটানো, করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রমে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেছে। বর্তমানে টিকা কার্যক্রম অনেকটা শেষ পর্যায়ে থাকলেও যুব সদস্যরা যেকোনো প্রয়োজনে কাজ করে যাচ্ছে।

red-1

 ভোলায় লকডাউন বাস্তবায়নে কাজ করে রেড ক্রিসেন্ট

প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরে প্রদীপ প্রধান বলেন, বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যুব রেড ক্রিসেন্ট প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আমাদের ৫৩ সদস্যের একটি দল আছে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেন দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হিসেবে কাজ করে। তাদের দুর্যোগ মোকাবিলা, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান ও রেড ক্রিসেন্টের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণরা কিভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে, সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় যুব সদস্যরা খেলার ছলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিক জানতে পারছে। কিভাবে ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজিত হতে পারে তরুণদের তা শেখানো হচ্ছে।

এছাড়া পপুলেশন মুভমেন্ট অপরেশনের আওতায় রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করছে। অনেকগুলো ক্যাম্প রয়েছে, যেখানে আমাদের যুব সদস্যরা স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি সাবন, গ্যাস সিলিন্ডারের মতো নিত্য ব্যবহার্য পণ্য বিতরণ কাজ করছে। মিয়ানমার রিফিউজি রিলিফ অপারেশন করা হচ্ছে। এছাড়াও ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবে রেড ক্রিসেন্টের রক্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দেশের মোট রক্তের চাহিদার শতকরা ১০ থেকে ১৩ শতাংশ রক্ত রেড ক্রিসেন্ট দিয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন ইয়ুথ কমিশনের ভাইস চেয়ার।

এমএইচ/এমআর 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর