মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪, ঢাকা

সিটির ভোটেই ‘ঘুম হারাম’

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০৪ মে ২০২৩, ০৮:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

সিটির ভোটেই ‘ঘুম হারাম’

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন কিছুটা টালমাটাল থাকলেও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথমদিকেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতিও এগিয়ে নিচ্ছে কমিশন। তবে তার আগে একযোগে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে যাচ্ছে ইসি। অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও স্থানীয় এই ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। বিশেষ করে, সংসদ ভোটের আগে এই নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো ধরণের বিতর্কের মুখে পড়তে না হয়, সেজন্য অনেকটা ঘুম হারাম কমিশনের!

গাজীপুর ছাড়া বাকি চার সিটিতে এখনো ভোটের বেশ বাকি। তবে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রতিনিয়ত ভোট নিয়ে কোনো না কোনো নির্দেশনা, বিজ্ঞপ্তি, বক্তব্য দিচ্ছে কমিশন। কখনো সরকারদলীয় প্রার্থীকে শোকজ, কোনো চিঠিতে আবার স্থানীয় প্রশাসনকে আচরণবিধি মানাতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা, আবার কোনোটিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সাহসের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা যাচ্ছে ইসি।


বিজ্ঞাপন


Electionনির্বাচন কমিশনের জারি করা একাধিক নির্দেশনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারদলীয় প্রার্থীদের নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তাদের। কারণ, মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে শোডাউন না করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েও ঠেকানো যায়নি গাজীপুরে নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানের শোডাউন। পরে দিতে হয়েছে শোকজের চিঠি।

এই সিটিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার খবর পেয়ে তাদেরও নিবৃত করতে আলাদা চিঠি জারি করতে হয়েছে কমিশনকে।

অন্যদিকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে আগামী জুনে নির্বাচন হলেও এখনই দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মাঠে নেমে গেছেন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। তার পক্ষে ব্যানার-পোস্টার, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে বরিশাল। নিয়মের বাইরে হওয়ায় তা অপসারণে নির্দেশনা দিতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।

গত ৩ এপ্রিল পাঁচ সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী, এরই মধ্যে গাজীপুর সিটি ভোটের মনোনয়নপত্র বাছাইও শেষ। রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিলের শেষ সময় ৪ মে। আর আপিল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আপিল নিষ্পত্তির শেষ সময় ৭ মে। এছাড়া প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৮ মে। সবশেষ প্রতীক বরাদ্দ ৯ মে এবং ভোটগ্রহণ ২৫ মে।


বিজ্ঞাপন


Electionএদিকে, খুলনা ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ১৬ মে, বাছাই ১৮ মে। এই সিটিতে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের শেষ সময় ২১ মে। পাশাপাশি আপিল কর্তৃপক্ষের আপিল নিষ্পত্তির শেষ সময় ২৪ মে এবং প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৫ মে। সবশেষ প্রতীক বরাদ্দ ২৬ মে ও ভোটগ্রহণ ১২ জুন।

অন্যদিকে, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৩ মে ও বাছাই ২৫ মে। এছাড়া আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল দায়েরের শেষ সময় ২৮ মে। আর আপিল কর্তৃপক্ষের আপিল নিষ্পত্তির শেষ সময় ৩১ মে। এই সিটিতে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১ জুন, প্রতীক বরাদ্দ ২ জুন ও ভোট ২১ জুন।

কোন সিটিতে কি হাল?

একযোগে পাঁচ সিটির ভোটের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বলায় সেই অর্থে উত্তাপ নেই। কিন্তু গাজীপুরে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রার্থী হওয়ায় বেশ আলোচনায় আসে এই সিটির ভোটের কথা। যদিও ঋণখেলাপির অভিযোগে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় আলোচনা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। সবশেষ বৃহস্পতিবারও (৪ মে) ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে তার প্রার্থিতার আপিল নামঞ্জুর হয়েছে। বিকেলে ঢাকা বিভাগীয় নির্বাচন কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম তার আপিল আবেদন নামঞ্জুর করেন। তবে শেষ পর্যন্ত আপিলে ফিরে না পেলেও যদি তার মা মাঠে থাকেন তাহলেও শেষ-অবধি উত্তাপ থাকবে গাজীপুরে।

অন্যদিকে বরিশালে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর বদলে তার চাচাকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে শুরুতে টক অব দ্যা কান্ট্রি ছিল এখানকার ভোটের আলাপ। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হচ্ছে।

Gazipurযদিও গাজীপুরে বিএনপি নেতার ছেলে ও বরিশালে বিএনপি দলীয় সাবেক মেয়রের ছেলে নির্বাচনের মাঠে নেমে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। এর বাইরে সিলেটে আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দিয়েছেন টানা দুইবারের মেয়র বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। দল ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও লন্ডন থেকে ফিরে এসে তিনি বিশেষ প্রেক্ষাপটের কথা বলে ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। 

এছাড়া রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের বর্তমান মেয়রের সঙ্গে সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল লড়তে পারেন এমন গুঞ্জন আছে। আবার বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নাদিম মোস্তফার ভাইও প্রার্থী হতে পারেন এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে।

অন্যদিকে খুলনার আওয়ামী লীগের মেয়রের সঙ্গে আগে মেয়র পদে লড়া বিএনপির অব্যাহতি পাওয়া নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুর মাঠে নামার আলোচনাও আছে। যদিও এই দুই সিটিতে শেষ পর্যন্ত বর্তমান মেয়রদের সঙ্গে কারা লড়বেন- তা জানতে আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে।

তফসিল থেকে যা করছে ইসি

তফসিল ঘোষণার পর ৮ এপ্রিল গাজীপুরে প্রার্থী ও তার সমর্থকরা প্লাস্টিকের ব্যবহার করে ও পরিবেশের ক্ষতি হয়- এমন প্রচারও চালাতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দিয়েছিল ইসি। এর ক’দিন পর সিটি নির্বাচন নিয়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে কমিশন। ১৭ এপ্রিলের ওই প্রশিক্ষণ শেষে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাতিলের ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের যত্নবান হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিশেষ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা মনোনয়ন বাতিল করার সময় কোন কোন কারণে করবেন এবং অর্ডারটা কীভাবে লিখবেন সেই বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এদিকে, গত ২৭ এপ্রিল সিটি নির্বাচনে সহায়তা দিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে নির্দেশনা দেয় ইসি। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে দেওয়া ওই চিঠিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতার পাশাপাশি নির্বাচনি আইন ও বিধিমালা আবশ্যিকভাবে পালনের জন্য বলা হয়।

Electionএর দুদিন পর নির্বাচনের আগে অনুমতি ছাড়া ভোটের এলাকা থেকে কাউকে বদলি করতে বা ছুটি না দিতে সরকারকে নির্দেশনা দেয় ইসি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সচিবকে দেওয়া সেই চিঠিতে বলা হয়, এই নির্দেশনা ভোটের ১৫ দিন পর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। সেই সঙ্গে একই চিঠিতে ভোটে আচরণবিধি লঙ্ঘন না করতে মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ন্ত্রণের জন্য মন্ত্রিপরিষদকে অনুরোধ করা হয়। শুধু তাই নয়, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যাতে প্রচারে অংশ নিতে পারেন তা সামনে রেখে দলীয় কার্যক্রম হাতে নিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকেও চিঠি দেওয়া হয়।

এদিকে, গত ২৬ এপ্রিল মনোনয়ন জমা দিতে শোডাউন না করার নির্দেশনা দিলেও তা মানেননি গাজীপুরের আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী। বিষয়টি নজরে আসার পর গত ৩০ এপ্রিল পরদিন শোকজ করা হয় গাজীপুরের আজমত উল্লা খানকে। সেই সঙ্গে আচরণবিধি ভঙ্গ করার অভিযোগে তাকে সশরীরে আগামী ৭ মে কমিশনে এসে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যও বলা হয়। পাশাপাশি তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে শাস্তি পেতে হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।

অন্যদিকে সময়ের আগে প্রার্থীরা ভোটের মাঠে নেমে যাওয়ায়- তাও সামাল দিতে হচ্ছে ইসিকে। গত মঙ্গলবার (২ মে) প্রতীক বরাদ্দের আগে কেউ যাতে প্রচার চালাতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয় ইসি। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মহানগরের পুলিশ কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের ইসির নির্দেশনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্যও আলাদা চিঠি দিয়েছে ইসি।

>> আরও পড়ুন: সিটি নির্বাচন উপলক্ষে সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ে মিডিয়া সেল গঠন

এতসব নির্দেশনা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ইসি। সব কাজ নির্বিঘ্নে করতে সাপ্তাহিক এবং সরকারি ছুটির দিনেও অফিস খোলা রাখতে বলা হয়েছে। কেবল নির্বাচন কমিশনের স্থানীয় কার্যালয় নয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি অন্যান্য দফতরও প্রয়োজনে খোলা রাখতে বলেছে ইসি। সবশেষ বুধবার (৩ মে) জারি করা চিঠিতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করার নির্দেশনা দেয় ইসি।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় এই ভোটকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরণের বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, সংস্থাটির প্রতি আস্থার সৃষ্টি হয় সেজন্য সব ধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেক বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকবে ইসি, যা সামনে হয়তো আরও দৃশ্যমান হবে।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার না চাইলে কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব। পাশাপাশি শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকলেও সুষ্ঠু ভোটের মাপকাঠি করা যায় না। তবে নিজেদের পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারলে ইসির আন্তরিকতা প্রকাশ পাবে।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনেকটা সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত হওয়ায় সবগুলোর ফলাফল তাদের হাতছাড়া হয়েছিল। এবারও হয়তো হস্তক্ষেপ না করে বিরোধী দলের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করবে সরকার ও ইসি। তবে শেষ পর্যন্ত এমনটা অব্যাহত নাও থাকতে পারে।’

বদিউল আলমের মত, ‘যদিও ইসির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা নেই, তারপরও তারা ভোটের মাঠে পুরো ক্ষমতা প্রয়োগ করলে কিছুটা হলেও সুষ্ঠু ভোট করতে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে পারে।’

বিইউ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর