বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনে গ্যাস লিকেজ আতঙ্ক, ‘নির্বিকার’ তিতাস

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৩৫ এএম

শেয়ার করুন:

মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনে গ্যাস লিকেজ আতঙ্ক, ‘নির্বিকার’ তিতাস

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি ঘটছে অগ্নি ও বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা। এর অধিকাংশই ঘটছে গ্যাস ও বিদ্যুৎজনিত কারণে। গত বছর গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুন থেকে ৭৯৫টি অগ্নিকাণ্ড ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরও গ্যাস লিকেজের কারণে বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গ্যাস লিকেজের কারণে পুরো রাজধানীজুড়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি গ্যাস লিকেজ নিয়ে বেশিরভাগ এলাকায় মসজিদ থেকে মাইকিং করে চুলা জ্বালাতেও নিষেধ করা হয়।

মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস লাইনে লিকেজের কারণে বাতাসে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর ইস্কাটন, তেজকুনিপাড়া, মহাখালীর ওয়ারলেস, টিবি গেইট, বারিধারা, বিডিআর ১ নম্বর গেইট, হাজারীবাগ, নয়াটোলা, মগবাজার, মুগদা ও কাজলাসহ রাজধানীর অনেক এলাকায়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সমালোচনা শুরু হলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পক্ষ থেকে বিষয়টির তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়- ঈদে শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে গেছে। এতে গন্ধ বাইরে আসছে। তিতাসের জরুরি ও টেকনিক্যাল টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া কিছু নেই। চুলা বন্ধ রাখতে হবে না। এটা যেহেতু ওভার ফ্লোর কারণে, তাই কনজাম্পশনে সমস্যা নেই।


বিজ্ঞাপন


ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, শুধুমাত্র ২০২২ সালে দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও গ্যাসের কারণে। এরমধ্যে গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুন থেকে ঘটেছে ৭৯৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা।

dm

চলতি বছরও গ্যাস লিকেজের কারণে বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত ৭ মার্চ রাজধানীর গুলিস্তানে বিআরটিসির বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে সাততলা একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ২৫ জনের মত্যু হয়। আহত হন দেড় শতাধিক মানুষ। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা গ্যাস থেকে হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না থাকায় লাইনের লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস জমা হয়ে যায় এবং সেই গ্যাস থেকেই শর্টসার্কিট বা দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর মধ্যদিয়ে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। যদিও লাইনের লিকেজের বিষয়টি মানতে নারাজ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। ১২ মার্চ ভবনটি পরিদর্শনের পর  তিতাসের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং দক্ষিণ) শামসুদ্দিন আল আজাদ বলেছিলেন, আমরা এখনো গ্যাসের আলামত পাইনি। এ দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক গ্যাস সৃষ্ট নয়।

এর দুদিন আগে ৫ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ৬ জন মারা যান, আহত হন অন্তত ৪০ জন। জমে থাকা গ্যাস থেকেই সায়েন্সল্যাব এলাকার ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল।

২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শিশুসহ ৩৪ মুসল্লির মৃত্যু ঘটে। পরে তদন্তে জানা যায়, তিতাস সংযোগ লাইনের লিকেজে মসজিদের ভেতর গ্যাস জমা এবং হঠাৎ বিদ্যুৎ স্পার্কিংয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।

dm

পুরো রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক ছাড়াও গ্যাস লিকেজ থেকে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তারপরও নির্বিকার তিতাস। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, গত ২৪ এপ্রিলের রাজধানীজুড়ে গ্যাসের গন্ধের ঘটনায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বড় কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই।

এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হারুন অর রশিদ মোল্লাহ বলেন, প্রতি বছর ঈদের সময় মিল-ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ থাকে। কিন্তু এবার কয়েকদিন ধরে যে ড্রাই সিচুয়েশন ছিল তখন থেকেই আমাদের কাছে এই ধরনের অনেক ফোন আসতে থাকে। মূলত সিদ্দিকবাজারের ঘটনার পর অনেকেই আমাদের কাছে অভিযোগ করে যে গ্যাসের গন্ধ পাই না। তখন গ্যাসের গন্ধটা একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার কারণে সামান্য লিকেজে যে গ্যাস বের হচ্ছিল সেটা থেকে গন্ধটা বেশি ছড়িয়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষ বেশি আতঙ্কিত হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের গ্যাস লাইন মানুষের বাসা-বাড়ির রাইজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়- এটা একটা পার্ট। আর রাইজারের পরে আরেকটা পার্ট। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে রাইজার পর্যন্ত। বাসা-বাড়ির ভেতরের দায়িত্ব হচ্ছে বাড়ির মালিক কিংবা গ্রাহকের। ৫০ বছরে রাস্তাঘাটে পাইপলাইন থেকে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নাই। যেগুলো ঘটেছে বাসার ভেতরে বা বিল্ডিংয়ের নিচে। বিভিন্ন কারণে গ্যাস জমা হয়ে যায়, সেখানে যখন আগুন লাগে তখন দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা ঢাকা শহরে রাইজার পর্যন্ত যে গ্যাস সরবরাহ করি এটার প্রেসার খুব কম। ৩০-৪০ পিএসআই। বর্তমানে যে পাইপলাইন আছে এতে ৬০ বছরের পুরাতন পাইপও আছে। বেশিরভাগ পাইপলাইন ১৫-২০ ফুট গভীরে। ৩০-৪০ পিএসআই গ্যাসের প্রেসার দিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নাই। কারণ গ্যাসের যে শক্তি তা উপরে উঠতে উঠতে একবারেই কমে যায়। এটাতে হয়তো সামান্য আগুন ধরতে পারে। কিন্তু বড় ধরনের দুর্ঘটনা হবে, বিল্ডিং ধ্বসে যাবে, এই ধরনের কোনো সম্ভাবনা নাই।

তবে তিতাসের এমডির এমন বক্তব্যকে দায়িত্বহীন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গ্যাস লিকেজ সমস্যা সমাধান না করে তিতাস পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

dm

এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, গ্যাস লিকেজের কারণে দুর্ঘটনার শঙ্কা নাই- এটা কারিগরি কথা না। গ্যাস লিকেজের বিষয়গুলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে তাদেরকে বারবার বলা হচ্ছে। এই ধরনের লিকেজের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। গ্যাস লিকেজ হচ্ছে, এটা থেকে প্রতিনিয়ত গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা কোনো মেরামতের খবর নাই। তারা প্রেসার কন্ট্রোল করার ক্ষমতাও রাখে না। তারা কিসের ভিত্তিতে বলছে যে আশঙ্কার কারণ নাই। তাদের ডিস্ট্রিবিউশন লাইন মেরামতের কোনো খবর নেই।

তিনি বলেন, মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এই গ্যাস ব্যবহার করছে। এরপরও কিসের ভিত্তিতে তাদের এই কথা গ্রহণযোগ্য হবে? প্রেসার কমিয়ে গ্যাস লিকেজ নিয়ন্ত্রণ করেই কি কাজ শেষ? গ্যাস লাইন মেরামত করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন অপসারণ করতে হবে। তারা বলে তাদের নাকি টাকা নাই, তারা প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে নিচ্ছে, যেটা নেওয়ার তাদের অধিকার নাই। সেসব টাকা কোথায় যায়?

dm

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম ঢাকা মেইলকে বলেন, তিতাসের কথা মতো পাইপলাইনের মধ্যেই অনেক ছিদ্র আছে। তাদের যে পাইপলাইন বিশ বছর মেয়াদের, সেটারও মেয়াদ দশ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। ফলে যে ছিদ্র হয়েছে সেটাও তারা বলেছে। লিকেজ থেকে গ্যাস বের হচ্ছে সেটা থেকে, তারা বলছে আশঙ্কার কিছু নাই। এটা তো দায়িত্বহীনের মতো কথা। আমার মনে হয়, তিতাস পাশ কাটিয়ে গিয়ে সমস্যাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সমস্যাটা যে অনেক গভীর, এটা যে অনেক ভালোভাবে সমাধান করা দরকার- এটা তারা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের তো মাঝেমাঝেই দুর্ঘটনা ঘটে। একটা স্বাভাবিক হিসাব। গ্যাস যদি একটা জায়গায় জমে থাকে সেখানে একটা দিয়াশালাই জ্বালালেও সেটা প্রচণ্ডভাবে বিস্ফোরণ ঘটাবে। মানুষ থাকলে মানুষ মারা যাবে সেখানে। এটা তো চাপের বিষয় না। তিনি উল্টাপাল্টা বললে তো হবে না। মোট কথা, ফুটা থাকলে লিকেজ হবে। এখানে চাপ যখন বেশি হয়েছে তখন সেখানে গন্ধ বেরিয়েছে। এখন যেমন চাপ কমিয়ে দিয়েছে, তার মানে এই নয় যে ফুটাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

টিএই/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর