শান্তিময় পৃথিবীর প্রত্যাশা ও নতুন বছরের মঙ্গল কামনার মাধ্যমে সারাদেশে উদাযাপিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ। ১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুরুর দিনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলাসহ নানা আয়োজন। বিভিন্ন সংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় একধিক অনুষ্ঠানের। এসব কর্মসূচিতে বাহারি রঙের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সবার আগে দিনটি উদযাপনে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করে ছায়ানট। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর রমনার বটমূলে গান, কবিতা ও নানা আয়োজনে নববর্ষকে বরণ করে নেয় তারা। গান-কবিতায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো বটমূল প্রাঙ্গণ। এবারের আয়োজন সাজানো হয় স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, আত্মবোধন আর জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। এ সময় তাদের পোশাকে ছিল বৈশাখী উৎসবের রং।
বিজ্ঞাপন
সমবেত কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ সংগীতে মুখরিত হয় রমনার প্রাঙ্গণ। তখন সামনের খোলা মাঠটি ছিল দর্শক-শ্রোতায় পরিপূর্ণ। দর্শকসারিতে ছিলেন বিদেশিরাও। ভাঙা ভাঙা বাংলায় গানে গানে অংশ নিয়েছেন বাঙালির প্রাণের উৎসবে।

এরপর শান্তিময় পৃথিবীর প্রত্যাশায় বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অনুষ্ঠিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় পদযাত্রাটি। পরে শাহবাগ মোড় ঘুরে পুনরায় চারুকলা অনুষদে শেষ হয়। বাহারি রঙের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরে এতে যোগ দিতে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তাদের পোশাকে ছিল চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির ছাপ। ঢোল-তবলা বাজিয়ে, নেচে গেয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পন্ন করেন তারা।
এদিকে বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে ঢাবি এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ, র্যাব, সোয়াত টিমসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর শতাধিক সদস্যরা যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কড়া পাহারায় ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
শোভাযাত্রার পদযাত্রা শুরুর সময়ে পুলিশ ও র্যাবের মোটরবাইক দল ছাড়াও সোয়াত টিমের সদস্যদের সমন্বয়ে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি করা হয়। এছাড়াও শাহবাগ থেকে টিএসসি সড়কের দুই পাশে অসংখ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি মোড়ে প্রস্তুত রাখা হয় পুলিশের একাধিক রায়ট কার।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে এটাকে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎসাহ-উদ্দীপনা দিন দিন বাড়ছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে শোভাযাত্রা হয়নি। গত বছর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্যোগে আবার সেটা হচ্ছে। প্রাণ ফিরে এসেছে। প্রত্যাশা ও সফলতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। যারা যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করতে চায়, এ সরকারের অবস্থান এ ধরনের চক্রান্তের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এখন এটি ওয়ার্ল্ড মেমোরি অব হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সম্পদ। এর রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ এবং এটি ছড়িয়ে দেওয়া এখন সবার সম্মিলিত দায়িত্ব। এটি অন্তর্ভুক্তমূলক দৃষ্টি ও দর্শনের প্রতিফলন। এটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার বার্তা সবসময়ই দিয়ে থাকে। যে আতঙ্ক ছিল, তার প্রতিবাদে সব শ্রেণির মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
এদিকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদেও বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ উদযাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আলোচনা সভা ও দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ আল মারুফ। সভাপতিত্ব করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দ্বীনী দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগের পরিচালক মো. আনিছুর রহমান সরকার।

সারাদেশে নানা আয়োজন
বাংলা নববর্ষ-১৪৩০ উদযাপনে রাজধানী ঢাকার বাইরেও নানা আয়োজন করে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। নববর্ষ উপলক্ষে সকাল ১০টায় সিলেট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার। এতে অংশ নেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনসহ স্থানীয় নানা শ্রেণি পেশার মানুষরা।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় উপস্থিত হয়ে সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রত্যাশা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নতুন বছর হবে সম্প্রীতির ও সহিষ্ণুতার। কাঁদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে সুন্দর একটি দেশ হবে। সরকার চায় একটা ফ্রি, ফেয়ার নির্বাচন। এখানে সরকার চাইলেই হবে না, সব রাজনৈতিক দল ও জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবার আন্তরিকতা থাকলে সুন্দর একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় নেত্রকোণায়। শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসন ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গানে, লোকজ নৃত্য, রাখি বন্ধন, আবৃত্তির মাধ্যমে নববর্ষকে আবহন করা হয়। শহরে বের করা হয় পৃথক দুইটি মঙ্গল শোভাযাত্রা।
জেলা প্রশাসনের মঙ্গল শোভাযাত্রাটি মোক্তারপাড়া খেলার মাঠ থেকে বের হয়ে পুরাতন কালেক্টরেট মাঠে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয়। অপরদিকে জেলা উদীচীর মঙ্গল শোভাযাত্রাটি নেত্রকোণা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অনেক অঞ্চলে বৈশাখি মেলাও আয়োজন করা হয়েছে। তবে এ বছরের নববর্ষ পবিত্র রমজান মাসে হওয়ায় এবং কয়েকদিনের তীব্র তাপদাহের কারণে এসব আয়োজনে লোক সমাগত সাধারণ অবস্থা থেকে কিছুটা কম লক্ষ্য করা গেছে।
এমএইচ/এএস

