শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পলাতক খুনের আসামি ব্রি’র কর্মকর্তা, পাচ্ছেন পদোন্নতি!

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২০ এএম

শেয়ার করুন:

পলাতক খুনের আসামি ব্রি’র কর্মকর্তা, পাচ্ছেন পদোন্নতি!

নয় বছর আগে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র সাদ ইবনে মমতাজ হত্যাকাণ্ড। সেই ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল দেশজুড়েই। ২০১৪ সালে ছাত্রসমিতির নির্বাচনে বিরোধের জের ধরে আলোচিত ও জনপ্রিয় ছাত্রলীগের ওই নেতাকে নিজ দলের সদস্যরা নির্মমভাবে নির্যাতনে চালিয়ে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পেরোলেও বিচার শেষ হয়নি; বরং আসামিরা আছেন ‘বীরদর্পে’।

হত্যাকারীদের অনেকেই ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান। আবার কেউ যোগ দিয়েছেন সরকারি চাকরিতেও! হত্যাকাণ্ডের আসামি কীভাবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করল, সেটি নিয়েও আছে প্রশ্ন। আলোচিত সেই মামলার পর্যাপ্ত কাগজপত্র হাতে পেয়েছে ঢাকা মেইল।


বিজ্ঞাপন


মামলার নথি ঘেঁটে এবং ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলোচিত সেই সাদ হত্যা মামলার ১৪ আসামির অন্যতম একজন হলেন মিজানুর রহমান। যিনি হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠানে। বাকি ১২ আসামি জামিন নেন। আর দুইজন আসামি শুরু থেকেই পলাতক। এরা হলেন মিজানুর রহমান এবং প্রশান্ত দে।

Special Newsসর্বশেষ হাইকোর্ট থেকে প্রশান্ত দে জামিন নিলেও আসামি মিজানুর পলাতক। সেই আসামি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পেয়েছেন সরকারি চাকরি! তাও এবার পাচ্ছেন সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতিও! অভিযুক্ত মিজানুর রহমান বিষয়টি অস্বীকার করলেও ব্রি কর্তৃপক্ষ বলছে, মামলার আসামি চাকরি করছেন, তারা বিষয়টি জানতেন না। এবার জেনেছেন এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

কি ঘটেছিল ৯ বছর আগে

ঘটনা ২০১৪ সালের ৩১ মার্চের। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে ছাত্রসমিতির নির্বাচনে বিরোধের জের ধরে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হলের ২০৫ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা সাদকে আটকে রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আলোচিত ও জনপ্রিয় ছাত্রলীগের এই নেতাকে কার্পেট দিয়ে মুড়িয়ে লোহার রড, লাঠি, হকিস্টিক দিয়ে পেটানো হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন ১ এপ্রিল সকালে মারা যান সাদ।


বিজ্ঞাপন


এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন হাওলাদার পরদিন ২ এপ্রিল অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা মামলায় পুলিশি তদন্তে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযুক্তরা হলেন- সুজয় কুমার কুন্ডু, রোকনুজ্জামান, সাদেকুর রহমান, রোকন, রেজাউল করিম, নাজমুল সাদাত, দেওয়ান মো. মুনতাকা মুফরাত, অন্তর চৌধুরী, সুমন পারভেজ, মিজানুর রহমান, ফয়সাল ইসলাম জয়, মনোয়ারুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ এবং প্রশান্ত দে।

অভিযুক্তরা প্রত্যেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এরমধ্যে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হলেও তারা বর্তমানে জামিনে মুক্ত রয়েছে। পরবর্তীতে বাকি ৫ জন হাজিরা দিলেও নাটোরের বাড়াইগ্রামের ভিটা কাজিপুরের মো. মিজানুর রহমান সুকৌশলে আজ-অবধি পলাতক রয়েছে। বর্তমানে মামলাটি ময়মনসিংহের চতুর্থ অতিরিক্ত জজ আদালতে বিচারাধীন।

মিজানুর আসামি হয়েও বনে গেলেন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা

২০১৪ সালের নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পরের বছর খুনের মামলার আসামি হয়েও প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হয়ে যান মো. মিজানুর রহমান। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই চাকরিতে যোগদান করেন এবং এক বছর পরই ২৭ জুলাই ২০১৬ সালে তার চাকরি স্থায়ী করা হয়।

হত্যা মামলার তথ্য গোপন করে চাকরি এবং পরবর্তীতে ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডের এআইটি থেকে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করে আসেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্রি’র একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে জানান, প্রতিবছরই সাদ হত্যার দিন হত্যাকারীদের নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়। সেখানে বারবার মিজানের নাম এসেছে তবুও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।

Special Newsব্রি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আসলে তাকে শুরু থেকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বাকৃবিতে পড়াশোনার কারণে বাকৃবির সিনিয়ররা তাকে এই সুযোগ ক্ষেত্র করে দিয়েছে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা। এ সময় ভেতরে ভেতরে সবাই জানে, কেউ প্রকাশ্যে বলে নাই- এও যোগ করেন তিনি।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, একজন আসামি সরকারি চাকরি করছে তাও ৮ বছর এটা ভাবা যায়! পুলিশ ভেরিফিকেশন যদি ম্যানেজ করেও যোগদান করে তারপরও কর্তৃপক্ষ এটার দ্বায় এড়াতে পারে না। আরও আগে ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল। এখানের কর্তৃপক্ষও জানে, তবে না জানার ভাব ধরে থাকে।

অনেকের এক বছরে স্থায়ী (চাকরি) হয় না, আর ওই ছেলের একদম এক বছরেই স্থায়ী কেন সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সবই যোগাযোগের কারিশমা বুঝলেন।

এদিকে, বাকৃবির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন- ওই হত্যা মামলার অনেক আসামিকে মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে দেখা যায়। অনেকেই জামিনে আছেন। আর সাদ হত্যার দিবস আসলে আসামিদের নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম রিপোর্টও করে। মিজানুরের বিষয়ে বাকৃবির একাধিক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাকৃবির অনেক সিনিয়ররা আছে, কেউ মন্ত্রণালয়ে নয়তো কোনো ভালো স্থানে। তাদের হাত ধরে সেও ভালো চাকরি করে যাচ্ছে। তা না হলে আসামিরতো চাকরি পাওয়ারই কথা না।

অন্যদিকে, আদালত সূত্রে জানা গেছে পলাতক আসামিদের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিষয়টিও। এরপরও ব্রি বলছে- তারা বিষয়টি জানেনই না!

দেওয়া হচ্ছে পদোন্নোতি

হত্যা মামলার তথ্য গোপন করে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থাইল্যান্ডে গিয়ে এআইটি থেকে মাস্টার্স কোর্স করেন মিজানুর। এবার সেই হত্যা মামলার আসামিকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। ব্রি’র গত ২২ মার্চের বিভাগীয় নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটির সভায় ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি (এফএমপিএইচটি) বিভাগের ‘ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা’ পদে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে বোর্ড অব ম্যানেজম্যান্ট। আগামীকাল সোমবার (৩ এপ্রিল) বোর্ড অব ম্যানেজম্যান্টের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

Special Newsঅভিযুক্ত কর্মকর্তার বক্তব্য

অভিযুক্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে শনিবার (১ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ফোন করা হলে ঢাকা মেইলের প্রতিবেদককে প্রথমে অফিসে যেতে বলেন তিনি। মিজানুর বলেন, ‘আপনি অফিসে আসেন, অফিসে কথা বলি।’

সাদ হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে এবং আসামি হয়েও চাকরি করছেন সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সাদ হত্যা মামলার বিষয়ে হ্যাঁ, ওই মামলার কি হইছে’- এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। ওই মামলায় আপনি একজন আসামি এবং দীর্ঘদিন পলাতক এ বিষয়টি উল্লেখ করলে মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কি জানি, আমিতো ওইটা জানি না। আপনি অফিসে আসেন, সামনাসামনি কথা বলি। আমি মিটিংয়ে আছি, ব্যস্ত আছি।’ এ বিষয়ে কিছুই জানেন না জানিয়ে আর কোনো উত্তর দেননি তিনি।

ব্রি কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাজাহান কবীর ঢাকা মেইলকে শনিবার (১ এপ্রিল) রাতে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি গত রাতে (৩১ মার্চ) প্রথম মেসেজটা পাইলাম। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা খুন হয়েছিল, সে (মিজানুর) নাকি পলাতক আসামি। কাগজগুলো দেখেছি। আমার কাছে অবাক লাগছে, সে ২০১৫ সালে নিয়োগ পাইল, পুলিশ ভ্যারিফিকেশন হইল, বিদেশ গেছে সে। এই সময়ের মধ্যে কেউ কিছু জানলো না- এটা অবাক লাগতেছে! আজকে অনেকেই এ বিষয়ে ফোন করতেছে। আমি একটু অবাক হলাম এতদিন কীভাবে ধামাচাপা ছিল।

Special-Newsব্রি’র মহাপরিচালক বলেন, রোববার যাচাই করে মন্ত্রী সচিবের সঙ্গে কথা বলব। আমি আমার জায়গা থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে, সেটি নেব।

মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নিলে সংস্থা পদক্ষেপ নেবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পদক্ষেপতো নিতেই হবে। এতবড় একটা ঘটনা, ইনস্টিটিউটের কেউ জানলো না- সেটাই অবাক লেগেছে। এটি আগেই প্রকাশ পেতে পারত বলেও মনে করেন তিনি।

ময়মনসিংহে পড়াশোনার কারণে প্রভাবশালীদের দ্বারা সুযোগ পেয়েছিল এমন অভিযোগ রয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখন যোগ দিয়েছিল তখন আমি ডিজি ছিলাম না। তবে এর পরীক্ষা নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ। আইবি’র মাধ্যমে টিকে এসেছে। এরপরে এখানে ভাইভা হয়েছে, তখনও এসব কিছু জানা যায়নি।

দীর্ঘদিন পরে হলেও বিষয়টি জানার পর অ্যাকশন না নিলে দ্বায় আপনাদের ওপর বর্তায় কিনা এমন প্রশ্নে ব্রি’র ডিজি বলেন, যাচাই-বাছাই করব, আমরা অ্যাকশন নেব। আমাদের আইন শাখায় কাজগপত্র দিছি যাচাই-বাছাই করার জন্য। আইন শাখার লোকদের নিয়ে রোববারই বসব, কি করা যায়। একই সঙ্গে এ দিন মন্ত্রী-সচিবকে বিষয়টি জানাবেন বলেনও জানান ব্রি’র মহাপরিচালক শাজাহান কবীর।

ডব্লিউএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর