শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

দেশীয় শিল্প বিকাশে আশা জাগাচ্ছে ‘কনক্রিট সড়ক’

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ২০ মার্চ ২০২৩, ০৮:৩০ এএম

শেয়ার করুন:

দেশীয় শিল্প বিকাশে আশা জাগাচ্ছে ‘কনক্রিট সড়ক’

সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে যুগের পর যুগ ব্যবহার হয়ে আসছে বিটুমিন (পিচ), যা মূলত আমদানি নির্ভর। এই বিটুমিন আমদানিতে গুণতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। ডলার সঙ্কট ও করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে আমদানিতেও ভাটা পড়েছে। এরইমধ্যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিটুমিনের পরিবর্তে কনক্রিটের সড়ক নির্মাণে জোর দেয় সরকার। এ সড়কের মূল উপাদান সিমেন্ট, রড, বালু ও পাথর। মান ও ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি এ সড়কে ব্যবহৃত উপাদানগুলো দেশীয় হওয়ায় চলমান প্রকল্পগুলো যেমন ফিরে পায় গতি, তেমনি দেশীয় শিল্প বিকাশেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর শুরু হওয়া ডলার সঙ্কট নতুন বছরে আরও বেড়েছে। ডলারের অভাবে এলসি খোলা যাচ্ছে না। এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি মূল্য মেটাতে না পারায় পণ্য নিয়ে বন্দরে জাহাজ আটকে থাকার মতো ঘটনাও ঘটছে। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোও ডলার সঙ্কটে নানা জটিলতায় ভুগছে। এমন অবস্থায় কনক্রিটের সড়ক নির্মাণে দেশীয় শিল্প বিকাশে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।


বিজ্ঞাপন


সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মহাসড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে বিভিন্ন বাজার, টোল প্লাজা, নাজুক অংশ স্বল্প পরিসরে ও বিচ্ছিন্নভাবে কনক্রিট দিয়ে গতানুগতিক পদ্ধতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। সওজ-এর বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় সড়কের গুরুত্বপূর্ণ ও নাজুক অংশে কনক্রিটের জেআরসিপি (রডসহ আড়াআড়ি জোড়াযুক্ত) পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ চলছে, যা বছরের পর বছর ঠিকে আছে।

Specialতারা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিটুমিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। যার কারণ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ভালো মানের বিটুমিন সরবরাহে ঘাটতি। অন্যদিকে কংক্রিট একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। অন্যদিকে দেশীয় সিমেন্ট ও রড শিল্প সক্ষমতার মাত্র অর্ধেক উৎপাদন করে থাকে। কনক্রিট সড়ক নির্মাণের পরিসর বাড়ানো গেলে এসব শিল্প পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

এরই মধ্যে কংক্রিটের মহাসড়ক নির্মাণে হাত দিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের প্রায় অর্ধেক নির্মাণ হচ্ছে কনক্রিটে। যা সাসেক-২ নামেও পরিচিত।

এ প্রকল্পে (সিআরসিপি- রডসহ আড়াআড়ি জোড়াবিহীন কনক্রিট সড়ক) মোট রডের পরিমাণ ০.৮৫ শতাংশ। যা অন্য দেশের তুলনায় কিছুটা বেশি। অধিক পরিমাণে সিআরসিপি নির্মাণকারী দেশগুলোতে ০.৬০ শতাংশ থেকে ০.৮৫ শতাংশ পর্যন্ত রড ব্যবহার করে থাকে। সাসেক-২ প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মিত সিআরসিপির প্রতি ঘনমিটার কনক্রিটে প্রায় ৪৫০ কেজি সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


Specialবিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনক্রিটের সড়ক নির্মাণে দেশের আমদানি নির্ভরতা কমছে। নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বৃদ্ধি পাবে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি।

যদিও কনক্রিটের সড়ক নির্মাণ ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিটুমিন থেকে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণে ১০ শতাংশ খরচ বেশি। তবে লাইফ টাইম হিসেবে ৫০ শতাংশ খরচ কম। কারণ ঘন ঘন সংস্কার করার প্রয়োজন হবে না এ সড়ক।

ধুঁকছে রড-সিমেন্ট শিল্প

রড তৈরির অন্যতম উপকরণ বা কাঁচামাল স্ক্র্যাপ। রড উৎপাদনের মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট। এই বিলেট উত্তপ্ত করে ছাঁচে ফেলে রড তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে রডের বাজারে। পাশাপাশি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডেও তৈরি হয়েছে জাহাজের সঙ্কট। ফলে এ শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন।

অন্যদিকে সিমেন্ট তৈরিতে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। এসব কাঁচামালের শতভাগই আমদানি-নির্ভর। নানামুখী সঙ্কটে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর উপর ভরসা করে টিকে আছে এ খাত। দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৪০টি প্রতিষ্ঠান (একই গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ) রয়েছে। তারা বলছেন, কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কাজে সিমেন্ট ব্যবহার ১৫-২০ শতাংশ কমে গেছে। কনক্রিটের মহাসড়ক নির্মাণ তাই আশা জাগাচ্ছে রড-সিমেন্ট শিল্পে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ) নির্বাহী পরিচালক শংকর কুমার রায় ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্তমানে সিমেন্ট খাত যে সঙ্কটের মুখোমুখি গত ৩০ বছরেও এতটা ভয়াবহ অবস্থায় পড়েনি। কারণ বিশ্ববাজারে কাঁচামাল, পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বাড়তি জ্বালানি খরচ।

Specialশংকর কুমার রায় বলেন, ডলারের দামের কারণে সিমেন্ট শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। বিটুমিনের তুলনায় কনক্রিটের সড়কের স্থায়িত্ব বেশি। সরকার যদি বিটুমিন থেকে সরে এসে কনক্রিটের সড়কে মনোযোগ দেয় এককভাবে, তা হলে দেশের জন্য যেমন ভালো হয়, সিমেন্ট শিল্পের জন্যও ভালো হয়। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের অর্ধেক কনক্রিটের নির্মাণ করা হচ্ছে- এটা অবশ্যই এ শিল্পের জন্য ভালো লক্ষণ। এটি রড শিল্প বিকাশে সহায়ক হবে।

সাসেক-২ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ইফাদ হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের পর এ সড়কে বিটুমিনের আস্তরণ দেওয়া হবে। এ সড়কে যাতায়াতে বিঘ্ন হয় এমন ফাটল সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি নেই, তবে কখনও হলে বিটুমিন দিয়েই সংস্কার করা হবে। কনক্রিটের উপর বিটুমিনের আস্তরণ দেওয়া হবে। সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে উন্নত প্রযুক্তিতে এ সড়ক নির্মাণে ঝাঁকুনি কমে আরামদায়ক যাতায়াত নিশ্চিত হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় এ সড়কের স্থায়িত্ব বেশি।

এ বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার রায় বলেন, মহাসড়কে বিস্তৃত পরিসরে সিআরসিপির বাস্তবায়ন হলে সড়ক উন্নয়ন প্রযুক্তি সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই ভ্রমণ হবে। নিরাপদ ও আরামপ্রদ হবে সড়ক পথ। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে ত্বরান্বিত। সরকারের ঘোষিত ২০৪১ সালের উন্নত-সমৃদ্ধ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সিআরসিপি প্রযুক্তি অন্যতম অনুষঙ্গ হতে পারে।

সন্তোষ কুমার রায় বলেন, বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত ‘জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশল’ এর নীতিমালা অনুযায়ী প্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে জাতীয় মহাসড়কসমূহ ৪/৬/৮ লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুতির সময় অত্যাধুনিক ডিজিটাল স্লিপ-ফর্ম পেডারের মাধ্যমে সিআরসিপি নির্মাণের সংস্থান রাখা হলে দেশীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও পেডার মেশিন আমদানি করবে।

ডিএইচডি/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর