শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৯:২৬ এএম

শেয়ার করুন:

প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের

ভৌগোলিক অবস্থানসহ নানা কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা৷ মুহূর্তেই ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের। এমন বাস্তবতার মধ্যেও ভূমিকম্প বা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। জরুরি অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কিছুই দিতে পারবে না তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৃষ্টিকর্তার ওপরই ভরসা।

ঢাকায় এ মুহূর্তে ভূমিকম্প কিংবা বড় কোনো দুর্যোগ হলে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা কি হবে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, দুর্যোগে বা জরুরি অবস্থাকালে কি কাজ তা সবেমাত্র আমরা নির্ধারণ করেছি। এটা একটা বিশাল ব্যাপার। মোকাবেলা কেউই করতে পারবে না। বড় বড় দেশগুলোও পারছে না। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন একটি ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে তা দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে বড় বড় টাওয়ারগুলো রয়েছে তার সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষা করা যাবে দুর্যোগকালে।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, শুধু বুদ্ধি দিয়ে দুর্যোগে কুলিয়ে উঠা যাবে না। আল্লাহ যদি রক্ষা করেন, তাহলেই রক্ষা। বিজ্ঞানের কোনো সূত্রই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারছে না।

Earthquakeভূমিকম্পের আগে কিছুই করার থাকে না জানিয়ে তিনি বলেন, মিরপুরের দিকে একটা ১২ তলা ভবন কাত হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারীরা সাত দিন টানাটানি করে পরবর্তীতে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। খোলা জায়গায় একটা ভবন কাত হয়ে যাওয়ার পর এ অবস্থা। আমাদের ঢাকার গিঞ্জি এলাকার এমন অবস্থা যেখান থেকে লাশ বের করা যায় না। আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। আগে সক্ষমতা ছিল না, এখন কিছুটা বেড়েছে। এ সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি রোধে প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে নগরের সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। ভবন নির্মাণে সাবধানতা অবলম্বন করলে ভূমিকম্পে ক্ষতি কমানো সম্ভব৷ প্রয়োজন সরকারের সব সংস্থার নজরদারি জোরদার করা এবং ভূমিকম্পের উপর প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া।

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে সামনে এনে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভবনগুলোর অভ্যন্তরীণ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার সীমাহীন দুর্বলতা ও নগর সংস্থাগুলোর সার্বিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, নজরদারি ও আইনের প্রয়োগের দুর্বলতার সামনে এসেছে। অগ্নিকাণ্ডসহ অতীতের নগর দুর্যোগের ফলে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর সুপারিশ আমরা কেন বাস্তবায়ন করতে পারিনি, সেই বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফায়ার সংক্রান্ত দেশের বিদ্যমান আইনে সাততলা ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ এ ১০ তলা ভবনকে বহুতল হিসেবে বিবেচনা করার ফলে সাত তলার উপর অনেক ভবনেই অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


আইপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, পুরান ঢাকা হতে রাসায়নিক গুদাম সরানোর জন্য কেমিকেল পল্লী স্থাপন প্রকল্পের আশু বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রকল্পের উন্নয়নকৃত ভূমিতে অতিবিপজ্জনক রাসায়নিক গুদাম সরানোর ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একইসাথে সারা দেশের ভবন নির্মাণে যথাযথ মানদণ্ড ও অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি অনতিবিলম্বে গঠন করে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

Cycloneএদিকে দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ২০১৫ সালে আরবান রিজিলিয়েন্স নামক প্রকল্প নেয় সরকার। ৮১৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় দুই সিটি করপোরেশনে দুটি ইওসি (ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার) স্থাপনের কাজ চলমান। এছাড়া আটটি জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ওয়্যারহাউজ রয়েছে এ প্রকল্পে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি ইওসিতে আছে ডেটা সেন্টার, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি, যা ব্যবহার করে ঘরে বসে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম তদারক করা যাবে। প্রতিটি ওয়্যারহাউজে থাকবে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য বিদ্যুৎচালিত হাতুড়ি, পাথর কাটার যন্ত্র, অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রসহ ৫৩ ধরনের যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া ওয়্যারহাউজেই থাকবে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, যা যুক্ত থাকবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে। আর এখানেই হবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ।

গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আপৎকালীন জরুরি সাড়াদানসহ উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

ডিএনসিসি সূত্র জানায়, জনবল ও পরিচালন নীতিমালার অভাবে অনেকটাই অকার্যকর এ প্রকল্প। ইওসি পরিচালনায় একজন পরিচালক, একজন উপপরিচালক নিয়োগ প্রয়োজন। নিরাপত্তা ও প্রস্তুতি, নিরাপত্তা পরিকল্পনা, সমন্বয়, সরঞ্জাম ও পরিচালনা, তথ্য ও প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, জনসংযোগ, অর্থ ইত্যাদি খাতে জনবল প্রয়োজন। কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী সঙ্কটও তীব্র।

তবে উত্তরের মতো প্রাথমিক সেবাটুকুও দিতে সক্ষম নয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ইওসি (ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার)।

Floodঅন্যদিকে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য দুই সিটি করপোরেশনের ওয়্যারহাউজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে গিঞ্জি এলাকায়। যেখান থেকে জরুরি সেবা দেওয়া অনেকটা অসম্ভব। এরই মধ্যে কোনো কোনো ওয়্যারহাউজ থেকে সরঞ্জাম চুরির ঘটনাও ঘটেছে।

তালতলা ওয়্যারহাউজটি নির্মাণ করা হয়েছে তালতলা কবরস্থানের গেট দিয়ে প্রবেশ করলে ডানদিকে একটি সরু রাস্তায়। যেখানে একাধিক লোক পায়ে হেঁটে চলাচল করাও দায়। উত্তরা ওয়্যারহাউজটি মহাসড়কের ওপর, যা ভাঙা হবে বিআরটি প্রকল্পের কারণে। সায়েদাবাদ ওয়্যারহাউজ বাসস্ট্যান্ডের সামনে। কারওয়ান বাজারেরটি ঘিঞ্জি এলাকায়।

অথচ এসব ওয়্যারহাউজ থেকে জরুরি অবস্থায় সরঞ্জাম বের করার সুব্যবস্থা নিশ্চিতসহ অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়ি প্রবেশ বা বের হওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল। এছাড়া ওয়্যারহাউজগুলোতে নেই প্রশিক্ষণ নেওয়ার উপযুক্ত জায়গা।

এ বিষয়ে আরবান রিজিলিয়েন্স প্রজেক্ট পার্টের প্রকল্প পরিচালক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের কার্যক্রম চলমান। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইওসি আমরা নির্মাণ করে দিচ্ছি। দুর্যোগের সময় তথ্য যোগাযোগে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের ইওসির মাধ্যমে মেয়র বা যারা এটার সাথে যুক্ত তারা তদারক করতে পারবেন।

ওয়্যারহাউজগুলোর কাজ নিয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক ওয়্যারহাউজ করা হয়েছে। সেগুলোতে কিছু সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। এগুলো মূলত ‘প্রাথমিক সহায়তা’ দিতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে সেখানে একটা করাত, শাবলের মতো সরঞ্জাম আছে, যেগুলো দিয়ে প্রাথমিক সহায়তা দেওয়া যাবে। ওয়ার্ডভিত্তিক কাজ নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমি শুনেছি ওয়ার্ডভিত্তিক একটা কমিটি করা হয়েছে। অনেক আগে। আমি আসার আগে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের একটি প্রতিবেদনে ভূমিকম্প বিশ্লেষকদের মতামতের ভিত্তিতে বলা হয়, রিখটার স্কেলে যদি সাত মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা৷ ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের।

২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেবার আতঙ্কেই ৬ জনের মৃত্যু হয়। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৪২ বার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ।

ডিএইচডি/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর