রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলা গার্ডেন সিটিতে পুলিশের গাড়ির চাপায় দারোয়ান ইউনুস বারী (৬২) মৃত্যুর পর চারদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশের দাবি, দারোয়ান ইউনুসকে চাপা দেওয়া গাড়ির মালিকের পরিচয় পাচ্ছেন না তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টিকে রহস্যজনক বলে দাবি করেছেন নিহতের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার আজিজুল হক ঢাকা মেইলের কাছে দাবি করেন, তারা বিষয়টি জানার জন্য বিআরটিএতে সেই গাড়ির নম্বর পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ফলাফল পাননি। একই দাবি করেছেন এই ঘটনায় করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নানও।
বিজ্ঞাপন
তবে নিহত দারোয়ান ইউনুস বারীর মেয়ে হাফসা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, সেদিন (২৭ ফেব্রুয়ারি) সেই পুলিশ অফিসার আমাদের সাথে ছিলেন। সেই গাড়িটি তার, তা তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু থানা পুলিশ বলছে সেই গাড়ির মালিকের পরিচয় তারা পাচ্ছেন না।
বিষয়টি যাচাই করার জন্য বুধবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের বসিলা গার্ডেন সিটিতে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে টানা চার ঘণ্টা অবস্থান করে জানা গেছে, গার্ডেন সিটির ডি ব্লকের ২ নম্বর সড়কের ১৩/১ নম্বর ‘ছায়াবীথি’ নামের বাড়িটিতে ছয় মাস ধরে চাকরি করতেন নিহত ইউনুস বারী। ভবনটির পার্কিং ভাড়া দেয়া হয়েছিল সেই গাড়ির মালিককে। সেই গাড়িটির মালিক পুলিশ অফিসার মিজানুর রহমান। তিনি পিবিআই’র ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ‘ছায়াবীথি’ ভবনটির পূর্বদিকে একটি ভাড়া বাসার দ্বিতীয় তলায় থাকেন পরিবার নিয়ে।
ছায়াবীথি ভবনের দারোয়ান মনতাজ জানান, সেই পুলিশ কর্মকর্তা ভবনটির নিচে থাকা পার্কিংয়ে গাড়ি রাখার জন্য ১৫০০ টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু তিন মাস তিনি কোনো ভাড়া পরিশোধ করেননি। ৯ তলা ভবনটির প্রতি ফ্লোরে তিনটি করে ইউনিট রয়েছে। সবমিলে ২৭টি পরিবার সেখানে থাকে। ভবনের পার্কিংয়ের যে অংশ সেই গাড়িটির জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছিল সেটির মালিক দেশের বাইরে থাকেন। তবে সেদিনের ঘটনার পর থেকে গাড়িটি পার্কিংয়ে আর রাখা হয়নি।
ভবনটির ২৭ জন মালিকের একজন ফিরোজ আহমেদ। তিনি বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মেইলকে জানান, তারা মালিকরা মিলে নিহত দারোয়ানের পরিবারকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দিচ্ছেন। এছাড়া তারা লাশ গ্রামে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও দিয়েছেন। কিন্তু গাড়ির মালিক এখনো তাদের সাথে এ নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
বিজ্ঞাপন
ভবনটির পাশে অবস্থিত বর্ণ এডমিশন কোচিং সেন্টারের হোস্টেলের কর্মী ফজলুল হক বলেন, সেদিন ঘটনার সময় আমরা নিচেই ছিলাম। হঠাৎ করে একটি শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি ওই দারোয়ান চাপা পড়েছেন। আমরা তাকে তুলে গাড়ির চালককে খুঁজতে থাকি। দেখি চালক গাড়ি দিয়ে চাপা দিলেও পাশেই দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন আর চুপ করে আছেন। দারোয়ান গেটের নিচে পড়ে কোকাচ্ছেন- এমন দৃশ্য দেখেও সেই চালক ভাবলেশহীন ছিলেন। তার এমন আচরণ দেখে আমরা অবাক হয়েছি। এরপর আমরা কজন মিলে চালকের সেই প্রাইভেটকারে আহত দারোয়ানকে তুলে দিলাম। এরপর শুনেছি তিনি মারা গেছেন। গাড়িটি একজন পুলিশ কর্মকর্তার বলে শুনেছি।
তাদের সাথে কথা বলে সেই পুলিশ কর্মকর্তা যে বাসায় ভাড়া থাকেন সেখানে গেলে নিচে একটি দোকানে থাকা দুই তরুণ-তরুণীর দেখা মেলে। তারা জানান, সেই পুলিশ কর্মকর্তা এই বাসার দ্বিতীয় তলায় থাকেন। তবে তার বেশি তারা কিছু বলতে রাজি হয়নি।
এলাকাবাসী জানায়, সেই পুলিশের এই এলাকায় কয়েকটি বাড়ি আছে। আছে গরুর খামারও। পিবিআইয়ের সেই ইন্সপেক্টরের দুই ছেলে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ২৭ বছর, আরেকজনের ১৭। তিনি নিজের বাসায় থাকেন না। বছিলা গার্ডেন সিটির বর্ণ এডমিশন কোচিং সেন্টারের পূর্ব পাশের শেষে ৫ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকেন। বুধবার সেই বাসায় গিয়ে দরজায় কলিংবেল চাপলেও কেউ বের হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একজন বলেন, এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চালক টুটুলকে কয়েক মাসে নিয়োগ দেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে বুধবার রাতে সেই পুলিশ অফিসার পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর মিজানুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেইলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি এক চিকিৎসকের চেম্বারে আছেন পরে বের হয়ে কথা বলবেন বলে জানান। ঘণ্টাখানেক পর তাকে আবারও কয়েক দফা কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
এদিকে চারদিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ সেই গাড়ির মালিকের পরিচয় জানতে পারেনি- এমন খবরে স্থানীয় লোকজন ও ভবনটির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, কোনো গাড়ির নম্বর, মালিকের নাম ও পরিচয় জানার জন্য মাত্র একটি ঘণ্টাই যথেষ্ট। পুলিশ কি ইচ্ছা করেই গাড়ির মালিকের পরিচয় জানাচ্ছে না- এমন প্রশ্নও তোলেন তারা। বিষয়টি নিয়ে তারা নানা ধরনের মন্তব্যও করেন।
এমআইকে/জেএম