শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:০৫ এএম

শেয়ার করুন:

ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী?

বাংলাদেশের দমকল বাহিনী অগ্নিনির্বাপণে দক্ষ হলেও প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল। ফলে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম ও চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ। এতে কয়েকশ মানুষ প্রাণ হারায়।

চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। খোদ রাজধানী ঢাকাতেই গত ২৬ দিনে (১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি) ৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ৩ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক। শতকোটি টাকার বেশি সম্পদহানি হয়েছে। কি কারণে একের পর এক মার্কেট ও ঘরবাড়িতে আগুন লাগছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।


বিজ্ঞাপন


রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানী অন্তত দুটি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এদিন বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে মালিবাগের মৌচাক টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। আধা ঘণ্টা পর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

fire

একইদিন রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে চলতি মাসে দ্বিতীয়বারের মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতিবছরই এই বস্তিতে আগুনের ঘটনা ঘটে।

রোববার কড়াইল বেলতলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নেভাতে এগিয়ে আসে। বস্তিবাসীরাও আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় বিকেল ৫টা ৩৩ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিকাণ্ডে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও ৬০টির মতো কয়েকটি কাঁচা ঘর পুড়ে গেছে।


বিজ্ঞাপন


এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ১১টা ৩৩ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এছাড়া চলতি মাসে ঢাকার আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে আছে গুলশানে আবাসিক ভবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের ১২তলা একটি আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আনোয়ার হোসেন (৩০) ও রাজিব পাইরিস রাজু (৩৯) নামে দুজনের মৃত্যু হয়। আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন কয়েকজন।

fire

ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে ১২তলা ভবনটির সপ্তম তলায় আগুন লাগে। এতে ভবনটির ১২ ও অষ্টম তলার অনেকেই আটকা পড়েন। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় রাত ১১টার দিকে আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তদন্তে জানা যায় ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না।

এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট এলাকার একটি প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লাগে। বিকাল ৪টা ৪৭ মিনিটে এই ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এছাড়া চলতি মাসে হাসপাতালেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল সোয়া ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের ডায়ালাইসিস ইউনিটে আগুন লাগে। ডায়ালাইসিস সেন্টারের বাইরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে আগুনের সূত্রপাত। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।

fire

তবে এ ঘটনায় হাসপাতাল জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে জসিম উদ্দিন (৬১) নামে এক নিউমোনিয়া রোগীর মৃত্যু হয়।

কেন এত বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা?

ফায়ার সর্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অপারেশন শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সোর্সগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের শর্ট-সার্কিট, চুলার আগুন, গ্যাসের পাইপ ফেটে যাওয়া, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, কেমিক্যাল ইত্যাদি। এসব বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ফলে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

fire

সচেতনতার ঘাটতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আমরা বিদ্যুতের লাইন চেক করি না। বিদ্যুতের সাব-স্টেশনগুলো ছয় মাসে দুইবার চেক করার কথা। আমরা একবারও তা করি না। এমনকি বছরেও একবার করি না। ফলে শর্ট-সার্কিটের ঘটনা ঘটছে। আমরা যেখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট বানাচ্ছি। বসত বাড়িতে আমরা বড় ধরনের আগুনের কাজ করছি। এছাড়া বিভিন্ন স্টক (গোডাউন) যেভাবে করার কথা সেভাবে করা হচ্ছে না। কেমিক্যাল স্টক করার জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে, সাধারণ গার্মেন্টস স্টকে তা হবে না। দুটির প্রটেকশন ব্যবস্থা ভিন্ন। স্টোর প্রটেকশনের বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। মালামাল অনুযায়ী যে নিরাপত্তা প্রয়োজন আমরা তা নিচ্ছি না। এসব কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটেছে।

প্রতিরোধে করণীয় এবং আমাদের প্রস্তুতি

অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত জানতে চাইলে জিল্লুর রহমান বলেন, অসচেতনার ঘটনাগুলো অনেকটাই ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটছে। আমি জানছি এটা কেমিক্যাল কিন্তু এর জন্য যতটুকু নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার, ছাড়পত্র নেওয়া দরকার, নিবন্ধনের প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না। সরকারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমি সাধারণ গার্মেন্টস গুডস দেখিয়ে কেমিক্যাল গুডস রাখছি। কেমিক্যালের জন্য যে লাইসেন্স নেওয়া দরকার আমি তা নিচ্ছি না। কেমিক্যালের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ পরিদর্শন করে লাইসেন্স দেয়। তখন ওই মালিকে অনেক কিছু করতে হবে, অনেক নিরাপত্তা বিধান রাখতে হবে। এসব খরচ কেউ করতে চায় না। তারা মনে করে এতে কোনো সমস্যা নাই। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রত্যেকের সচেতনা দরকার।

gulsan

ফায়ার সর্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতার বিষয়ে জানতে চাইলে জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা সেবা প্রদান করি। কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের চেষ্টা করি। পাশাপাশি সচেতনতা তৈরি জন্য আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি, মহড়া দেই। আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু আমরা তো বল প্রয়োগ করতে পারি না যে এটা কেন করেছেন? ওইটা করেন। মানুষকে সচেতন করার জন্য যতটা করার দরকার আমরা তাই করছি। আমরা গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, এলাকাভিত্তিক সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমরা স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করছি যেন তারা আমাদের সাথে সেবা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে।

ফায়ার সর্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আধুনিকায়নের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে পর থেকে আমরা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হচ্ছি। বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় অনেক আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের হাতে এসেছে। এখন আমাদের আধুনিক গাড়ি, রোবট ফায়ার ফাইটিং, টিটিএলের (যে মেশিনের সাহায্যে ভবনের ২৪ তলা পর্যন্ত আগুন নেভানো যায়) মতো আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে।

এমএইচ/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর