শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সাগর কন্যার যত রূপ!

তারিক আবেদীন
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৪৫ এএম

শেয়ার করুন:

সাগর কন্যার যত রূপ!

অপরূপ সৈন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই দেশ। সাগর-নদী, বন-বনানী, পাখপাখালিতে ভরা অপরূপ বাংলাদেশ। এদেশের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছে বেশ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত। তার মধ্যে একটি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। যা সাগর কন্যা হিসেবে পরিচিত। এটি পৃথিবীর একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখানে সূর্যদয় এবং সূর্যাস্ত একই সাথে উপভোগ করা যায়। সমুদ্রের পেট চিরে সূর্য উদয় হওয়া এবং সমুদ্রের বক্ষে সূর্যকে হারিয়া যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা নিঃসন্দেহে দারুণ ব্যাপার। তাইতো পর্যটকদের কাছে এটি বেশ আকর্ষণীয়।

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগর কন্যা কুয়াকটা পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নে এর অবস্থান। ঢাকা থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব ৩৮০ কিলোমিটার, বরিশাল থেকে ১০৮ কিলোমিটার। কথিত আছে, ‘কুয়া’ শব্দটি এসেছে ’কুপ’ থেকে। ধারণা করা হয় ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতারিত হয়ে আরাকানীরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তখন এখানে সুপেয় জলের অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়ো বা কূপ খনন করেছিলনে, সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা।


বিজ্ঞাপন


নানা রূপ ও গুণে গুণান্বিত সাগর কন্যা কুয়াকাটা। কুয়াকাটা বেড়িবাঁধ পেরিয়ে সমুদ্র সৈকতের দিকে যেতেই বাম দিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে। এরপরই কয়েক গজ দক্ষিণে ‘ফার্মস অ্যান্ড ফার্মস’ এর রয়েছে বিশাল নারিকেল বাগানসহ ফল ও ফুলের বাগান। এই বাগানের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট, ওই পিকনিক স্পট পরিদর্শনের পরেই রয়েছে কাঙ্ক্ষিত ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিশাল সমুদ্র সৈকত। এই সৈকতের পূর্ব দিকে এগুলোই প্রথমে দেখা যাবে নারিকেল বাগান, সুন্দর আকৃতির ঝাউ বাগান। বন বিভাগের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রজাতির ঝাউগাছ লাগিয়ে সমুদ্র সৈকতের শোভা বর্ধন করা হয়েছে। এ নারিকেল ও ঝাউবাগানের মধ্যেও রয়েছে পিকনিক স্পট যেখানে পর্যটকরা দল বেঁধে বনভোজনের অনাবিল আনন্দে নিজেদের একাকার করে তোলে। তার থেকে একটুই পূর্ব দিকে আগালেই চর-গঙ্গামতির লেক, সেখান থেকে একটু ভেতরে দিকে এগুলেই সৎসঙ্গের শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম ও মিশ্রীপাড়া বিশাল বৌদ্ধ বিহার। সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে লেম্বুপাড়ায় প্রতি বছর আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত জেলেরা প্রাকৃতির উপায়ে গড়ে তুলে শুঁটকি পল্লী। এই পল্লীতে সাগরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিক উপায়ে শুঁটকিতে রূপান্তরিত করে সারাদেশে সরবরাহ করে।

কুয়াকাটাতে সূর্যোদয় দেখার জন্য ঝাউবনে যাওয়াই ভালো। সেখান থেকেই সূর্যাস্ত ভালো দেখা যায়, সমুদ্রের পেট চিরে কীভাবে সূর্য উঠে তা দেখার জন্য অনেক লোকই আগেভাগেই চলে আসে। সকাল বেলা হেঁটে হেঁটে ঝাউবনে যেতে সময় লাগবে ২০ মিনিট। আর ভ্যানে গেলে লাগবে ১০ মিনিট। সেখানে সারি সারি গাছ ভালো লাগবে। এই বনটি সরকার বনায়ন পরিকল্পনার অধীনে তৈরি করেছে। কারো কারো কাছে সূর্যোদয়ের চেয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্যটা বোধহয় বেশি চমৎকার লাগে। সূর্যটা সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার সময় রংয়ের পরিবর্তনটা আপনি স্পষ্টই দেখতে পাওয়া যায়।

সমুদ্রের গর্জন দিনের বেলা সাধারণত আশপাশের শব্দের কারণে শোনা যায় না। সমুদ্রের যে একটা ভয়ংকর রূপ আছে তা বোঝা যায় রাতে। যদি রাতে সমুদ্রের গর্জন শুনতে চান তবে অবশ্যই যেতে পারেন সেখানে। নিরাপত্তা জনিত কোনো ভয় নেই সেখানে। তবে রাতের সমুদ্রের গর্জন সত্যিই ভয়ংকর। সৈকতের কাছাকাছি কোনো হোটেলে থাকলে গর্জন হোটেল থেকেও শোনা যেতে পারে। দর্শনার্থী ও ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এই সৈকতে আছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ও ঘোড়া। ভাড়া সাধারণত দূরত্ব ও সময় অনুযায়ী হয়। কুয়াকাটার আশপাশের বেশ কয়েকটি চর আছে। সেগুলো দেখতে আপনি যেতে পারেন স্পিডবোট ও ট্রলার কিংবা ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকায় করে। কুয়াকাটায় সমুদ্র সৈকতের আশপাশে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট রয়েছে। সেগুলোতে রান্না করার সকল ব্যবস্থা আছে। চুলা, খড়ি, হাড়ি ও পাতিল থেকে বাবুর্চি পর্যন্ত।


বিজ্ঞাপন


এক নজরে কুয়াকাটায় দর্শনীয় স্থানসমূহ
ফাতরার বন: সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে ম্যানগ্রোভ বন শুরু হয়েছে, যার নাম ফাতরার বন। সংরক্ষিত বনভূমি ফাতরার বন ইতোমধ্যে দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে রয়েছে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ফাতরা, গরান, বাইন ও গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং বানরসহ অসংখ্য জীবজন্তু ও পাখি। সমুদ্র সৈকত থেকে ইঞ্জিন চালিত বোটে এক ঘণ্টার যাত্রাপথে ফাতরার বনে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

কুয়াকাটার ‘কুয়া’: কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের কাছে রাখাইন পল্লী কেরানীপাড়া শুরুতেই একটা বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে রয়েছে প্রাচীন কুপগুলোর মধ্যে একটি। তবে বারবার সংস্কারের কারণে এর প্রাচীন রূপটা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। 

শুঁটকি পল্লী: কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিমে জেলে পল্লীর অবস্থান। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শুঁটকি তৈরির মৌসুম চলে সেখানে। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে সৈকতের পাশেই শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। সেখান থেকে কম দামে কিনে নিতে পারেন পছন্দের মাছের শুঁটকি।

ক্রাব আইল্যান্ড: কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পূর্বদিকে গেলে দেখবেন ক্রাব আইল্যান্ড বা কাঁকড়ার দ্বীপ। সেখানে নির্জন সৈকতে ঘুরে বেড়ায় হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার দল। এই দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

কেরানিপাড়া: সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে থেকেই শুরু হয়েছে রাখাইন আদিবাসীদের পল্লী কেরানীপাড়া। এখানকার রাখাইন নারীদের প্রধান কাজ কাপড় বুনন।

আলীপুর বন্দর: কুয়াকাটা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় একটি মাছ ব্যবসা কেন্দ্র আলীপুর। এই বন্দর থেকে প্রতিদিন শতশত ট্রলার বঙ্গোপসাগরে যায় মাছ ধরতে।

মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির: কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বে রাখাইন আদিবাসীদের আরেকটি বাসস্থল মিশ্রিপাড়ায় রয়েছে আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরেই রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি। এখান থেকে কিছু দূরে আমখোলা পাড়ায় রয়েছে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাখাইন বসতি।

গঙ্গামতির জঙ্গল: কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পূব দিকে শেষ হয়েছে গঙ্গামতির খালে গিয়ে। আর এখানে শুরু হয়েছে গঙ্গামতির বা গজমতির জঙ্গল। বিভিন্ন রকম গাছপালা ছাড়াও এই জঙ্গলে দেখা মিলতে পারে বন মোরগ, বানর ও নানা রকম পাখির।

টিএই/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর