বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

স্মৃতিচারণে আবেগাপ্লুত টংক আন্দোলনের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৭:০৪ এএম

শেয়ার করুন:

স্মৃতিচারণে আবেগাপ্লুত টংক আন্দোলনের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং

কুমুদিনী হাজং। বিপ্লবের জীবন্ত কিংবদন্তি। ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এই কুমুদিনী হাজংকে ঘিরেই সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল টংক আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে বাতিল হয় টংক প্রথা। সময়ের সাথে সাথে একে একে বিদায় নিয়েছেন সেই অগ্নিসময়ের বিপ্লবী সন্তানেরা। তাদের মধ্যে শুধু কুমুদিনী হাজং বেঁচে আছেন কালের সাক্ষী হয়ে।

ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের একমাত্র সাক্ষী কুমুদিনী হাজং থাকেন নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বহেরাতলী গ্রামে। শতবর্ষী এই নারী টংক আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সম্প্রতি সেই স্মৃতিচারণ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ওয়াজেদ হীরা। 


বিজ্ঞাপন


বিরিশিরির উৎরাইল বাজার ছেড়ে এগিয়ে গেলে সোমেশ্বরী নদী। সেই নদী পার হলে পথেই পড়ে টংক আন্দোলনের শহীদ স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। সেই সৌধকে পেছনে ফেলে কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়ির দিকে যাত্রা। টিনের চালায় হেলে পড়েছে একপাশে বাগানের গাছ আর বড়ই। একটু পরপর বড়ই ঝরে পড়ছে। পাকা ভিটায় বসলেন কুমুদিনী হাজং। নেত্রকোনার দুর্গাপুর সীমান্তে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এখন বহেরাতলী গ্রামের গাছগাছালিতে ভরা একটি পাহাড়ি টিলায় থাকেন। সঙ্গে থাকেন মেজ ছেলে অর্জুন হাজং ও তার পরিবার।

biri2

গত ৪ ফেব্রুয়ারি এই কুমুদিনী হাজংকে দেখতে যান জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও তাঁর সফরসঙ্গীরা। দীর্ঘসময় কথা বলেন, খোঁজ নেন শারীরিক ও পারিবারিক। বয়সের ভারে ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে বসে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন কুমুদিনী হাজং। যদিও চোখে কম দেখেন, সম্প্রতি তিনি কানেও শোনেন কম। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সার্বিক খোঁজ নিয়ে তাকে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি শীতবস্ত্র দেন। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেলে দুর্গাপুর উপজেলা থেকে উপজেলা প্রশাসন চাল-ডালসহ বিভিন্ন ফল পাঠিয়েছে। জানতে চাইলে উপজেলা থেকে আগত ব্যক্তিরা বলেন- প্রতিমাসেই তাকে এভাবে সহযোগিতা করা হয়। নিয়মিতই দেখভাল করা হয়।

আন্দোলনের একমাত্র সাক্ষী কেমন আছেন, কীভাবে দিন কাটছে জানতে চাইলে কুমুদিনী হাজং বলেন, ‘শরীরটা ভালো না। আগের মতো শক্তি নেই। হাঁটা কষ্ট।’


বিজ্ঞাপন


সেই দিনগুলোর স্মৃতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনি সিংহের সাথে করা আন্দোলনের কথাগুলো। ওই দিনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। এছাড়াও অতিথিদের বারবার আপ্যায়নের কথা বলে যাচ্ছিলেন। তিনি বলতে থাকেন- আমার কাছে এসেছেন, আমি একটু চা খাওয়াতে পারছি না, কিছু খাওয়াতে পারছি না।

বাড়ির অন্য সদস্যরা জানান, সকালে বাড়ির পাশের উঠানে বসে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। শীতের দিন সেখানে রোদ পোহান তিনি। এরপর দুপুরে গোসল করে কিছু সময় বিশ্রাম নেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসেন। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের লোকজন, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এলে কথা বলেন।

ছোট ছোট বাক্যে সেই সময়ের নানা কথা তুলে ধরলেন কুমুদিনী হাজং। বললেন, সেই সময় আমি ছোট, নতুন বিয়ে হয়েছে। শীতের একটি সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনাও দেন তিনি।

biri3

বৃহত্তর ময়মনসিংহের সুসং জমিদারি এলাকায় টংক প্রথার প্রচলন ছিল। ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে জমিদারকে দিতে হবে। ১৯৩৭ সালে শোষিত কৃষকেরা এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন, যা টংক আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৩৭ সালে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে কৃষকরা এই প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

২০০০ সালে কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বরের মৃত্যু হয়। তাদের তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে লমিন হাজং থাকেন একটু দূরে, বিজয়পুরের গুচ্ছগ্রামে। ছোট ছেলে সহদেব হাজং মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতে চলে গেছেন। বড় মেয়ে মেনজুলি হাজং মানিকগঞ্জে ও ছোট মেয়ে অঞ্জুলী হাজং থাকেন ঢাকায়।

সমাজসেবায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে কুমুদিনী হাজংকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয় বাংলা একাডেমি। এছাড়া তিনি অনন্যা শীর্ষদশ (২০০৩), ড. আহমদ শরীফ স্মারক (২০০৫), কমরেড মনি সিংহ স্মৃতি পদক (২০০৭), সিধু-কানহু-ফুলমণি পদক (২০১০), জলসিঁড়ি (২০১৪) ও হাজং জাতীয় পুরস্কার (২০১৮) পেয়েছেন।

বেসরকারি সংস্থা দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের (ডিএসকে) নির্বাহী পরিচালক ও কমরেড মনি সিংহের ছেলে দিবালোক সিংহ এর আগে জানিয়েছেন, ডিএসকে থেকে কুমুদিনীকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। প্রতি মাসে একজন চিকিৎসক তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, টংক আন্দোলনে হাজং সম্প্রদায়ের অনেক ত্যাগ আছে। ব্রিটিশদের হাতে নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। আমি এই কুমুদিনী হাজংয়ের কথা অনেকবার শুনে থাকলেও দেখা হয়নি এর আগে। কুমুদিনী হাজংয়ের সাথে কথা বলে দেখা করে তার সার্বিক খোঁজ নিয়েছি। বয়সের ভারে নুব্জ্য হয়ে গেছেন, তবে এখনো স্মৃতিগুলো বেশ প্রখর। সরকারিভাবে তাকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ।

biri4

কুমুদিনী হাজং ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে জানা যায়, সময়টা ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। শীতের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ব্রিটিশ পুলিশ দল টংক আন্দোলনকারীদের খোঁজ করার নামে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালায় বহেরাতলী গ্রামে। এই গ্রামের টংক আন্দোলনের আদিবাসী নেতা লংকেশ্বর হাজংকে না পেয়ে ঘরে থাকা তার নববিবাহিত রূপসী স্ত্রী কুমুদিনী হাজংয়ের সঙ্গে পুলিশ অশালীন আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে ক্যাম্পের দিকে। কুমুদিনীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে_ এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে প্রতিবাদী আদিবাসীরা তীর-ধনুক, ঝাঁড়ূ, দা, লাঠি ও বল্লম হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। তৎকালীন টংক আন্দোলনের নারীনেত্রী রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে শতাধিক নারী-পুরুষ সোমেশ্বরী নদীতীরে এসে পুলিশের পথরোধ করে দাঁড়ায়। প্রতিবাদী হাজংরা পুলিশ দলকে নারী নির্যাতন করায় ভর্ৎসনা করে। তাদের কথায় কর্ণপাত না করে কুমুদিনীকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সশস্ত্র সৈন্যরা নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালায়। রাশিমণি হাজং ও তার সহযোগী ছয় মহিলাসহ ঘটনাস্থলেই ২২ জন এবং দুজন ব্রিটিশ পুলিশ নিহত হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কুমুদিনীকে রেখে পুলিশ দল ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দেয়। লাশ পড়ে থাকলে আবার পুলিশ আসবে এই ভয়ে গ্রামবাসী কোনো রকমে লাশগুলো সৎকার করে ভাসিয়ে দেয় সোমেশ্বরী স্রোতে। এতেও শেষ রক্ষা পায়নি গ্রামবাসী। পরদিন ব্রিটিশ পুলিশ এসে পুরো গ্রাম তছনছ করে দিয়ে যায়। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেদিন।

দীর্ঘদিন গ্রামটি জনশূন্য হয়ে ছিল। নারী নির্যাতনের ঘটনা ও রাশিমণি হাজংয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের বহেরাতলী গ্রামে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। নীল আকাশ আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধটি হাজং মাতা রাশিমণির স্মরণে নির্মিত হয় ১৯৯০ সালে।

ডব্লিউএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর