শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পাতাল রেলের কাজে খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে শঙ্কা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩২ এএম

শেয়ার করুন:

পাতাল রেলের কাজে খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে শঙ্কা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

পূর্বাচল এলাকার বাসিন্দা হাসনাত আরা কাজল। স্বপ্নের মেট্রোরেলের উড়াল পথের পর এবার পাতাল মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন-১) নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার খবরে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই তার। কারণ স্বল্প সময়ে দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দেওয়া যাবে এতে। কিন্তু শঙ্কা দীর্ঘ মেয়াদী খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ে। 

প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে কাজল বলেন, বায়ু দূষণের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব দেখছে দেশ। ঢাকায় গত মাসে (জানুয়ারি) সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছেন নগরবাসী। গেল মাস পুরোটাই ছিল উদ্বেগের। জানুয়ারিতে মোট ৯ দিন রাজধানীর বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বছরের পর বছর খোঁড়াখুঁড়ি করা হলে- ধুলা আর দূষণে এলাকা ছাড়তে হয় কিনা তাই ভাবছি।


বিজ্ঞাপন


পাতাল রেলের কাজ উদ্বোধন ঘিরে পূর্বাচল রুট (নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো) আশপাশের মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাসও দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানান, মেট্রোরেল আগারগাঁও স্টেশনে থেকে উত্তরা পর্যন্ত অংশ ঘুরেছি। দেশে থেকেও বিদেশে থাকার অনুভূতি। এখন নিজেদের এলাকায় ট্রেন আসছে, তা আরও উন্নত। চলবে মাটির নিচ দিয়ে। তবে খোঁড়াখুড়ি শুরু হয়ে গেলে কতটা ভোগান্তি বাড়বে তাই নিয়ে চিন্তিত। 

ব্যবসায়ী মো. শফিকুল জামান জানান, মেট্রোরেলের কাজের জন্য হয়তো দীর্ঘ কয়েক বছর দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কর্তৃপক্ষ কাজে গড়িমসি না করলে কষ্ট কমবে। তিনি বলেন, ট্রেন চালু হলে তীব্র যানজট হয়তো কমবে। অল্প সময়ে অফিসে যাওয়াসহ আমরা প্রয়োজনীয় কাজ সারতে পারব।

অপেক্ষার প্রহর ঘুচিয়ে আজ (২ ফেব্রুয়ারি) নির্মাণকাজের উদ্বোধন হবে দেশের প্রথম পাতাল বা ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেলের। সশরীরে নির্মাণকাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর রুটে হবে এই পাতাল মেট্রোরেল। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। এরমধ্যে পাতাল অংশে থাকবে ১২টি স্টেশন।

metro rail


বিজ্ঞাপন


এমআরটি-১ নামে পরিচিত ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল দুটি অংশে বিভক্ত। এরমধ্যে একটি বিমানবন্দর রুট (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) ও অন্যটি পূর্বাচল রুট (নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো)। যারমধ্যে পূর্বাচল রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। এই অংশটি সম্পূর্ণ উড়াল। এ ক্ষেত্রে মোট ৯টি স্টেশনের ৭টি স্টেশন হবে উড়াল। বাকি দুটি (নর্দ্দা ও নতুন বাজার) স্টেশন বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসেবে পাতালে নির্মিত হবে। যা পরবর্তীতে নতুন বাজার স্টেশনে এমআরটি-৫ এর সঙ্গে যুক্ত হবে।

এমআরটি সূত্রে জানা গেছে, এমআরটি লাইন-১ এর নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। এটির নির্মাণকাজ মোট ১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আবুল কাসেম ভূঁঞা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোর কাজ ২৬ জানুয়ারি শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে, দিনটি পরিবর্তন করে ২ ফেব্রুয়ারি করা হয়েছে। ওইদিন পাতাল রেললাইন নির্মাণকাজের ফলক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমেই মূলত প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজ শুরু হবে।

এর আগে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেছিলেন, এ কাজের জন্য আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করব। খননে যে মাটিগুলো নরম ছিল বা যেখানে নিচের মাটিগুলো শক্ত হয়নি, সে জন্য সেন্ড পাইলিং করব। অর্থাৎ নির্ধারিত স্থানের নিচের দিকে অতিরিক্ত খনন করা হবে। এরপর সেখানে বালি দিয়ে পাইল বা শক্ত করা হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা 
‘বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের’ (এনসিএ) আহ্বায়ক ও বায়ুন্ডলীর দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) চেয়ারম্যান  অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, বায়ু দূষণের উৎসগুলো মোটামুটিভাবে রাস্তার উপরে। দুইভাবে হচ্ছে এটা। একটা হলো খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় বড় প্রকল্পগুলো রাস্তার উপর করা হচ্ছে। আরেকটি উৎস হচ্ছে ইটের ভাটা। ঘুরে-ফিরে ইটের ভাটাও রাস্তায় আসছে। গত ১৫ বছর বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করে আমরা বুঝতে পেরেছি এটা একটা রাস্তার সমস্যা। 

কামরুজ্জামান বলেন, আমরা যদি অল্প সময়ে নির্মাণ কাজগুলো করতে পারি। যদি সুন্দরভাবে নির্মাণবিধি মেনে কাজ করতে পারি তাহলে সমস্যার সমাধান হবে। গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে পরিমাণ দুর্যোগপূর্ণ বায়ু সেবন করেছে নগরবাসী, ইতিহাসে এমন বায়ু কখনোই সেবন করে নাই। যেখানে বায়ু দূষণ জনিত জরুরি স্বাস্থ্যগত অবস্থা জারি করার কথা। এমন সময়ে কাজ করার জন্য পানি ছিটাতে হবে। উন্নয়ন কাজের সঙ্গে সঙ্গে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বায়ু দূষণ একটা ফলাফল। দূষণের কারণগুলো আমরা জানি। এরমধ্যে নগরায়ন এবং উন্নয়নের যে পদ্ধতি অনুসরণ করছি তা ঠিক আছে কিনা দেখা দরকার। যদি ঠিক থাকত তাহলে বায়ু দূষণসহ দূষণের মাত্রা এতটা খারাপ হওয়ার কথা না। নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণযজ্ঞের ধুলাবালিই বতমানে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। দেখা যায়- একদিকে ভবন নির্মাণ বেড়েছে সেই সাথে অবকাঠামো প্রকল্প বেড়েছে। রাস্তা বারংবার খোঁড়াখুঁড়ি বেড়েছে। যেখানে কোনো ধরনের নীতিমালা মানা হচ্ছে না। 

তিনি আরও বলেন, নির্মাণ কাজের তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের কোনো যন্ত্রই কাজ করে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের তদারকি তো হচ্ছেই না বরং মেট্রোর মতো অবকাঠাম বা নিজেদের উন্নয়নের জন্য সড়ক খনন করছেন সেখানেও নীতিমালা মানা হচ্ছে না।

আদিল মাহমুদ বলেন, বলা হচ্ছে পাতাল রেল মাটির নিচ দিয়ে যাবে, দূষণ হবে না। বাস্তবে তা নয়, রাস্তা কেটে ফেলা হবে। এ পাতাল রেলের কারণে রাস্তাসহ আশে পাশে কল্পনাতীত দূষণ তৈরি হবে। এ দূষণ নেওয়ার মতো কি ঢাকার অবস্থা রয়েছে? নেই। পাতাল রেল যে কতটা উচ্চবিলাসী পরিকল্পনা তা আমাদের আলোচনায় আছেই। এ মুহূর্তে যা পরিবেশের জন্য নাজুক পরিবেশ তৈরি করবে তা কেন করা হচ্ছে। আগামী ১০ বছর পর ঢাকার উন্নতি হলে করতে পারতাম। এ পাতাল রেল তো আর ম্যাজিক না। সেই অর্থে কিছুই হবে না। গণপরিবহনের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। যে কোনো শহরকে বাঁচাতে হলে সবুজায়ন করতে হয়। আমরা তার বিপরীত কাজ করছি। 

ডিএইচডি/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর