বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ফ্ল্যাটের চেয়ে বস্তির ঘর ভাড়া বেশি!

কাজী রফিক
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২২, ০৯:০৫ এএম

শেয়ার করুন:

ফ্ল্যাটের চেয়ে বস্তির ঘর ভাড়া বেশি!

উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অংশীদার রাজধানীতে বসবাসকারী বস্তিবাসীও। দেশগঠনে অবদান থাকলেও তাদের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া বরাবরই কম। রাজধানীর বস্তিগুলোতে বাস করা মানুষ এখনো নানা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তবে তাদের আছে নানা ভোগান্তি ও বেশি দামের ঘর ভাড়া। বস্তির ঘরে নাগরিক সুবিধা তেমনটা না থাকলেও আয়তনের দিক দিয়ে হিসাব করলে দেখা যায় এই ঝুপড়ি ঘরের ভাড়া নগরীর অনেক অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটের চেয়েও বেশি।
  
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ‘বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা জরিপ ২০১৪’ অনুযায়ী, রাজধানীতে বস্তি আছে ৩ হাজার ৩৯৪টি। আর এসব বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ।

জরিপ মতে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট বস্তির সংখ্যা এক হাজার ৬৩৯টি। সেখানে বসবাস করেন চার লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বস্তির সংখ্যা এক হাজার ৭৫৫টি। দক্ষিণ ঢাকায় বস্তিবাসীর সংখ্যা এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বস্তি রয়েছে রাজধানীর আদাবর থানা এলাকায়।


বিজ্ঞাপন


bosti

আদাবর ১০, ১৬, ১৭, ১৭/বি এলাকার বেশ কয়েকটি বস্তি ঘুরে দেখা যায়, এসব বস্তিতে প্রতিটি ঘরের জন্য বস্তিবাসীকে ভাড়া গুনতে হয় আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। একেকটি ঘরের আয়তন ৯০ থেকে ১২০ বর্গফুট। সে হিসেবে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দাঁড়ায় ২৮ থেকে ৪২ টাকা। যা এ এলাকার ফ্ল্যাট বাসার ভাড়ার দুই থেকে তিনগুণ। আবার দ্বিগুণ ভাড়া গুনলেও বস্তির মানুষজন ঠিকভাবে পাচ্ছেন না নাগরিক সুবিধা।

অন্যদিকে এই এলাকার ৯০০ বর্গফুটের দুই কক্ষ বিশিষ্ট একেকটি ফ্ল্যাটের ভাড়া ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দাঁড়ায় ১৫ থেকে ১৬ টাকা।

আর তিন কক্ষ বিশিষ্ট ১২০০ থেকে ১৩০০ বর্গফুট আকারের ফ্ল্যাটের ভাড়া ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দাঁড়ায় প্রায় ১৫ টাকা।

আদাবর-১০ নম্বর রোডের বাসিন্দা মুনসুর হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত বছর ভাড়া আছিল ৪ হাজার ৩০০ টাকা। এই বছর করছে ৫ হাজার। তাও ঠিক মতো পানি থাকে না। পাক ঘরে মহিলাগো প্রতিদিন চিল্লাচিল্লি লাগে।’

আদাবর মেহেদীবাগ এলাকার বাসিন্দা টুম্পা আক্তার বলেন, ‘বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়ানোর তালে থাকে। কিন্তু পানির সমস্যা, ময়লার সমস্যা থাকেই। এক পাকঘরে সবাই মিলা রান্না করা লাগে। ঝামেলা লাইগাই থাকে। আবার বচ্ছরে দুইবার ভাড়া বাড়ায়।’

bosti

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, শেরেবাংলা নগর এলাকায় ১৩৮টি বস্তি রয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব বস্তিতে বসবাসকারী নিম্নআয়ের মানুষকে প্রতি বর্গফুটের জন্য ভাড়া গুনতে হয় ২৫ থেকে ৪৫ টাকা পর্যন্ত। নোংরা পরিবেশ, মশার উপদ্রব, সুপেয় পানির সংকট, অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার থেকে শুরু করে নানা সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে এসব বস্তিতে বসবাসকারীদের।

অথচ পাশেই মিরপুর ৬০ ফিট এলাকায় ৯০০ থেকে এক হাজার বর্গফুট আকারের ফ্লাট বাসার ভাড়া ১৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। সকল নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন এসব ফ্ল্যাট বাসায় প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ১৫ থেকে ১৬ টাকা।

মিরপুর রোডের বিপরীতেই মোহাম্মদপুর। ৫টি ওয়ার্ডের এই বিশাল এলাকায় বস্তির সংখ্যা ২৮৪টি। এরমধ্যে বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড় এলাকার চাঁদ উদ্যান সোনা মিয়ার টেক্কি এলাকায় দেখা যায়, ৮০ থেকে ১২০ বর্গফুট আকারের একেকটি ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে ২২০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ২৫ থেকে সাড়ে ২৭ টাকা।

আবার চাঁদ উদ্যান, নবীনগর, ঢাকা উদ্যান, সাত মসজিদ হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হাউজিং, কাটাসুর এলাকার বাসিন্দাদের বস্তিতে প্রতি বর্গফুটের জন্য ভাড়া গুনতে হয় ২৫ থেকে ৪৫ টাকা। অথচ এরমধ্যে অনেক এলাকায় সিটি করপোরেশনে নব্য সংযোজিত। সেখানে এখনো নগর সেবা পৌঁছায়নি। আবার কিছু জায়গা আছে, যা এখনো সিটি করপোরেশনের আওতাতেই আসেনি। ফলে সড়ক বাতি, সুয়ারেজ সেবাসহ নগর ভবনের কোনো সেবাই পাচ্ছেন না এসব বস্তির বাসিন্দারা।

মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৫ নম্বর সড়কের বস্তির প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ২৪ টাকা। বস্তির ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও মিটারের দেখা নেই। ঘর প্রতি মাসে ২০০ টাকা নেওয়া হয় বিদ্যুৎ বিল। আর পানির জন্য গুনতে হয় ঘর প্রতি ১৫০ টাকা। আর সেই পানিও আনতে হয় অন্তত একশো গজ দূর থেকে। আবার টিনশেডের ঘরগুলোর ভাড়া সাড়ে তিন হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত।

এ এলাকার ৯০০ থেকে ১৩৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বাসার ভাড়া ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। বর্গফুট হিসাবে ভাড়া দাঁড়ায় ১৫ থেকে ১৮ টাকা।

মোহাম্মদীয়া হাউজিং এলাকার বাসিন্দা সুমনা ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘টিনশেড বাসার ভাড়া বছরে দুই থেকে তিনবার বাড়ে। কোনো অজুহাত পেলেই বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ায়। কিন্তু ভাড়াটিয়াদের সুবিধার দিকটা মোটেও দেখে না।’

bosti

চাঁদ উদ্যান এলাকার বাসিন্দা মো. মিরাজ অভিযোগ করে বলেন, ‘বাড়িওয়ালা বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়াইছে। আবার এই মার্চে আইসা কইলো এপ্রিল থেকে আবার ভাড়া বাড়বে। গ্যাসের দাম নাকি বাড়ছে। আমরা তো মাসে এক সপ্তাহও গ্যাস পাই না। একদিন গ্যাসের লাইন দেয়, কয়দিন পর আইসা তিতাসের লোক লাইন কাইটা দেয়। পানি ঠিক মতো পাই না। খুব জ্বালায় আছিরে ভাই।’

দেশে ভাড়াটিয়া আইন থাকলেও তা কার্যকর না। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ ভাড়া বৃদ্ধির উপর বাধানিষেধ অংশে বলা হয়েছে, কোনো বাড়ির ভাড়া বেশি বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও, আদায়যোগ্য হবে না। একই আইনে মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বাড়ি মালিকদের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। যদিও এ আইন যেন কাজীর গরুতে রূপ নিয়েছে। যা কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভাড়াটিয়া পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. মোস্তফা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা বিষয়টি আগেও দেখেছি। আমরা এটা নিয়ে কাজও করেছি। ছোট বাসার ভাড়া ফ্ল্যাট বাসার চাইতে বেশি। এর কারণ হচ্ছে, বড় বাসা সবাই নিতে পারে না। ফলে এ সুযোগটাই বাড়িওয়ালারা নেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে অনেকবার বলেছি, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ একটা আইন আছে। এটার সংস্কারও হয় না। মানা-মানিও ঠিকভাবে হয় না। এর কোনো প্রয়োগই নেই।’

কারই/এমআর/এএস   

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর