শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বায়ু দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি, ৯ প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

বায়ু দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি, ৯ প্রস্তাব
ফাইল ছবি

ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগতভাবে চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নয়টি প্রস্তাব দিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। বায়ু দূষণ কমাতে নগর এলাকাসহ সারাদেশে অবকাঠামো, ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যথাযথ মানদণ্ডে প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার (২৮ জানুয়ারি) আইপিডির উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘রাজধানীর বিপর্যস্ত বায়ু: নগরায়নের বিদ্যমান প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক পর্যালোচনা সভায় এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়।


বিজ্ঞাপন


আয়োজকরা বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ইটভাটার ধোঁয়া, সড়কের নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়াখুঁড়ি, অবকাঠামো ও মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো প্রভৃতি কারণে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার বায়ু দূষণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছ। শুষ্ক মৌসুমে যার প্রভার থাকে সবচেয়ে বেশি। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার জলাভূমি ভরাট এবং সবুজ এলাকা ও সবুজায়ন কমে যাওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণ, নগর ও পরিবেশের ভারবহন ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়ে কংক্রিটনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন গতি প্রভৃতি কারণে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রায় চলে গিয়েছে। সড়ক খনন নীতিমালার কোনো প্রয়োগ নেই; পরিবেশ আইন, বিধিমালা ও নীতিমালার প্রতিপালন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের ভূমিকা অতি দুর্বল। প্রভাবশালীরা আইনের ঊর্ধ্বে থেকে গিয়ে ব্যবসা বা শিল্প-কারখানা স্থাপন করে পরিবেশকে উপেক্ষা করে নির্বিচারে বায়ু দূষণ করে যাচ্ছে। 

আইপিডির নয়টি প্রস্তাবনা

১. সব ধরনের নির্মাণ (অবকাঠামো ও ভবন) কর্মকাণ্ড কঠোর নজরদারিতে আনা।

২. ঢাকার পরিবেশ ও নগরের ভারবহন ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণে কার্যকর ও যথাযথ নিয়ন্ত্রণ।


বিজ্ঞাপন


৩. অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি নির্ধারণের মাধ্যমে শুধু ‘অতি জরুরি’ ও ‘দূষণে ন্যূনতম প্রভাব রাখবে’ এমন শ্রেণির অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ।

৪. অবকাঠামো নির্মাণে যুক্ত ঠিকাদারদের বায়ুমানের নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নীতি গ্রহণ।

৫. যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় তদারকি এবং ভবনে এসি’র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ।

৬. নগরে মানসম্মত পাবলিক বাস, প্যারাট্রানজিট ও গণপরিবহন বৃদ্ধির আশু উদ্যোগ গ্রহণ।

৭. ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্লক ইট ব্যবহারের সরকার ঘোষিত নির্দেশনার বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ।

৮. ঢাকার চারপাশে পরিকল্পনামাফিক সবুজ এলাকা ও সবুজ বেষ্টনি তৈরি করা।

৯. পরিবেশ আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে শক্তিশালী করা এবং এক্ষেত্রে যথাযথ নজরদারি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা।

কার্যকরী উদ্যোগ ও তদারকি বাড়ানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার চেয়েও নারায়ণগঞ্জ এলাকার বায়ুমান বিপজ্জনক মাত্রাকে আরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে, পুরো জানুয়ারি মাসেই যা গড়ে প্রতিদিন বায়ুমান সূচক (একিউআই) ৪০০ বা তার চেয়ে বেশি ছিল। ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার বায়ু দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার্যকর ক্লিন এয়ার আইন করতে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম, কারা এই আইন করতে দেয়নি - এই বিষয়গুলোর জবাব নীতিনির্ধারকদের দিতে হবে। বায়ু দূষণ রোধ করতে কার্যকর প্রকল্প, নির্মাণ ও নগর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

EN2

আইপিডি পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, বায়ূ দূষণে শুধু স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ই নয়, এতে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় ও জিডিপি কমে যায়। বায়ু দূষণ কমাতে নগর এলাকায় অনাচ্ছাদিত এলাকায় ল্যান্ডস্কেপিং ও সবুজায়নের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক বায়ুরমান নিয়মিত তদারকি করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামালউদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে। বায়ূ দূষণকে এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগের চেয়ে ও ভয়ংকর মন্তব্য করে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বায়ু দূষণ কমানো সম্ভবপর হবে না।

কানাডার সেন্ট মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিষয়ক গবেষক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী, খুলনার বায়ু দূষণ এর মাত্রা ও উদ্বেগজনক। সারাদেশে মাত্র ১১টি পয়েন্টে রাষ্ট্রীয়ভাবে বায়ুমান পরিমাপ করা হচ্ছে, যা বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে অপ্রতুল। এগুলোর সংখ্যা বাড়াতে হবে।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক মারুফ হোসেন বলেন, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে উদাহরণ তৈরি করবার সুযোগ রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়ে দূষণ বাড়ছে। বায়ু ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের গণ আন্দোলন কেন দিনে দিনে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করে দূষণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ বাড়াতে হবে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, বায়ু দূষণের কারণে আমাদের আকাশের উপরিভাগে ‘ডাস্ট ডোম লেয়ার’ তৈরি হচ্ছে, যা আমাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।

জাপানের মতো দেশে উন্নত প্রযুক্তি ও কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশে এই ধরনের উদ্যোগের সক্ষমতার অভাবে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির উদ্যোগে পরিবেশ দূষণ আরও বাড়তে পারে।

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মো. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বায়ু দূষণ রোধে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক শহরের ৩০ ভাগ বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা ও আশেপাশের শহরে এমন সবুজায়ন ও বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দূষণ রোধে সফল কলোম্বিয়ার বোগোটা, পোল্যান্ডের ওয়ারশ, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, ঘানার আক্রা প্রভৃতি শহরের মতো ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে পাবলিক বাসের সংখ্যা বাড়ানো ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং সবুজ বাহন তথা সাইকেল ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।

ডিএইচডি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর