বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

বাসা থেকে তুলে নিয়ে দেওয়া হলো ছিনতাই মামলা!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৭:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

বাসা থেকে তুলে নিয়ে দেওয়া হলো ছিনতাই মামলা!

বুধবার সকালে দুটি নষ্ট ফোন ঠিক করার জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আজিজখান রোডের বাসা থেকে বের হন সুজন মিয়া (২২)। বাসার গেটেই তাকে আটক করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই বাশার। পরে তাকে থানায় নিয়ে সারাদিন আটকে রেখে রাতে দেয়া হয় ছিনতাই চেষ্টার মামলা।

তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে সুজনের বাসার সামনে প্রতিবেশীরা এই প্রতিবেদককে বলেন, সুজন খুবই ভালো ছেলে। একটা ছেলেকে সকালে বাসার সামনে থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে রাতে ছিনতাইচেষ্টার মামলা দেয়া হলো। তাহলে ছিনতাই করল কোন সময়?


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ছেলে থানা হাজতে, বাইরে মায়ের কান্না

তারা বলেন, সুজনের বাবা ২৬ দিন আগে মারা গেছেন। এর আগে তার বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। সে সময় সুজন বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার সময় তাকে আটক করে পুলিশ এবং তার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক মামলা দেয়। সেই মামলায় পাঁচদিন আগে জেল থেকে বেরিয়ে আসে সুজন। তার মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। এখন সংসারে পুরুষ বলতে কেউ নাই।

অন্যদিকে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বুধবার রাতে এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, সুজন একজন পেশাদার ছিনতাইকারী। তার নামে ধানমন্ডি, হাতিরঝিল ও মোহাম্মদপুর থানায় তিনটি ছিনতাই মামলা রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুজনের নামে ধানমন্ডি থানায় একটি রাজনৈতিক মামলা ছাড়া আর কোনো মামলা নেই। ওসির কাছে সুজনের নামে মামলাগুলোর নম্বর চাইলে তিনি তা দিতে পারেননি।

sujon

শুক্রবারে দুপুরে আবারো মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, সুজনের নামে ছিনতাই চেষ্টার মামলা হয়েছে।

প্রতিবেশীরা যা বলছেন

বৃহস্পতিবার বিকেলে এই প্রতিবেদক সরেজমিন আজিজ খান রোড এলাকায় যান। এ সড়কের মাঝপথে থাকা সিরাজ বাবুর্চির বাড়ি। এই বাসাতে থাকে সুজনের পরিবার।

প্রতিবেশী রাশেদা বলেন, সুজনের নামে কখনো থানায় মামলা ছিল না। মাসখানেক আগে তার বাবা অসুস্থ থাকায় হাসপাতালে যাওয়ার পথে পুলিশ আটক করে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা দিয়েছে। এছাড়া তার নামে কোনো মামলা নেই। সেই মামলায় তিনি ২৫ দিন কারা ভোগ করে চারদিন আগে জামিনে বেরিয়ে আসেন। বুধবার তিনি দুটি ভাঙ্গা মোবাইল নিয়ে মেরামতের জন্য দোকানের দিকে যাচ্ছিলেন। বাসা থেকে বের হওয়ামাত্রই তাকে পুলিশ আটক করে। পরে জানতে পারি পুলিশ তার বিরুদ্ধে ছিনতাইচেষ্টার মামলা দিয়েছে। তার কাছ থেকে নাকি দুটি চাকু উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, পোলাটারে আমাগো সামনেই ধইরা নিয়ো গেল, তার কাছ থাইক্যা আবার চাকু পাইল কই?

পরে কথা হয় ‍সুজন যে বাসায় থাকেন (সিরাজ বাবুর্চির বাসা) সেই বাসার ম্যানেজার মালেকের সাথে। তিনি বলেন, সুজনের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ধরনের অভিযোগ ছিল না। এলাকায় সবাই তাকে ভালোভাবেই চেনে।

আরও পড়ুন: ঢাকায় বেড়েছে চুরি, ৩ মাসের তথ্য মনিটরিংয়ের নির্দেশ কমিশনারের

সেই বাসার নিচে পাশের দোকানে ভাত বিক্রি করেন রেখা নামের এক নারী। তিনি বলেন, সুজন এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত।

পরিবার যা বলছে

বৃহস্পতিবার বিকেলে তাদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, সুজনের মা রব্বানা বেগম তাদের ঘরে বিছানায় কাঁদছেন। পাশে তাকে এক বৃদ্ধা নারী সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এই প্রতিবেদককে দেখেই কাঁদতে শুরু করেন।

তিনি বলেন, ওরা আমার পোলাটারে মাইরা ফেলাইব বাবা। পোলায় কোনোদিন কারও ক্ষতি করে নাই। কিন্তু তারে বাসার গেট থাইক্যা ধইরা ছিনতাই মামলা দিল! এখন আমি কি করুক? এ সময় সুজনের মা তার একটি আইডি কার্ড দেখান। যেখানে দেখা যায়, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানে হাউসকিপার হিসেবে কাজ করেছেন সুজন।

thana2

সুজনের মা আরও বলেন, সুজনকে বুধবার থানায় নেয়ার পর মোহাম্মদপুর থানার গেটে গেলে এসআই বাশার আমাকে ফোন করেন এবং ৫ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিলে তার ছেলের মামলা হালকা করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়ে ১ হাজার টাকাও নেন। কিন্তু বাকি টাকা না দিতে পারায় সুজনের নামে ছিনতাইয়ের মামলা দেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘প্রকাশ্যে মাইরা ফেললো, তাগোরে কেমনে জামিন দেয়?’

এ সময় সুজনের বোন সুমাইয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, আমার ভাইটারে ধইরা নিয়া পুলিশ এখন কয় তার কাছ থাইকা নাকি দুইটা ছুরি পাইছে! তাইলে সুজনের কাছে থাকা দুইটা মোবাইল গেল কই?

দুটি মোবাইলের মধ্যে একটি সুজনের বড় ভাবি মাকসুদার। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি সুজনকে মোবাইল ভালো করার জন্য বাইরে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু পরে শুনি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন থানায় গিয়েছিলাম কিন্তু পুলিশ মোবাইল দেয়ার কোনো কথাই বলল না। উল্টো বলে তার কাছে নাকি চাকু পেয়েছে। তাহলে আমার মোবাইল গেল কই?

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও পুলিশ যা বলছে

বিষয়টি শুনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আশিক ফারদিন ঢাকায় মেইলকে বলেন, যদি সত্যিই এরকম ঘটনা হয়ে থাকে তবে এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়বে। ‌এগুলো অবশ্যই মেনে নেয়ার মতো ঘটনা নয়। ভুক্তভোগী আমাদের এখানে অভিযোগ করলে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আমরা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে ‌এরকম ঘটনা যেন পুলিশের মাধ্যমে না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক করা হবে।

এ ঘটনা সাবেক আইজিপি শহীদুল হককে জানালে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, যদি এরকম ঘটনা ঘটে থাকে তবে সেই পরিবার যেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনের কাছে অভিযোগ করেন। তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এ বিষয়ে ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের এডিসি মৃত্যুঞ্জয় দে সজল ঢাকা মেইলকে বলেন, এই অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি এ বিষয়ে একটু খবর নেই। আর সে ছিনতাইকারী কিনা এই মুহূর্তে তো বলতে পারছি না। কি তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে ধরেছে সেটাও জানতে হবে।

এমআইকে/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর