রোববার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রতারণায় রিজেন্ট সাহেদকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি!

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

প্রতারণায় রিজেন্ট সাহেদকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি!

‘আপনি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতি মহোদয় হলেও আমার চাচাজান। আপনি না হলেও আমার চাচাজান। আমার অভিভাবক।’ গত পাঁচ দিন আগে এমডি বিল্লাল ফারদিন নামের এক ব্যক্তি নিজের ফেসবুকে উপরোক্ত কথাগুলো লিখে একটি স্ট্যাটাস দেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.ক.ম. মোজাম্মেল হকের সঙ্গে তার একটি ছবিও পোস্ট করেন। মন্ত্রীকে চাচা পরিচয় দেওয়া এই যুবক নিজেকে গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রহমত আলীর ছেলে বলে দাবি করতেন। এমনকি তা সত্য প্রমাণ করতে বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে নিয়মিত ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করতেন।

বহুমাত্রিক প্রতারণার মাধ্যমে এই যুবক সাহেদ করিম ওরফে রিজেন্ট সাহেদকেও হার মানিয়েছেন। প্রতারণার ধরনে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সাহেদের সঙ্গে তুলনীয় আরেক প্রতারকের খোঁজ মিলেছে। অবশেষে শেষ রক্ষা হয়নি তারও। সাহেদের মতো তাকেও গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।


বিজ্ঞাপন


গ্রেফতারের আগে বহুমাত্রিক প্রতারণার মাধ্যমে একের পর এক নারীর সঙ্গে প্রেম ও পরকীয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এভাবে কমপক্ষে ৪০ নারীকে প্রেম-পরকীয়ার ফাঁদে ফেলে হাতিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। ডিএমপির কলাবাগান থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তাকে গত বুধবার রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর বেরিয়ে আসে তার আসল পরিচয়।

raju2

জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, এমডি বিল্লাল ফারদিনের আসল নাম রাজু উল্যা। তবে ভিন্ন ভিন্ন নাম-পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করতেন তিনি। কারও কারও কাছে তিনি মাসুম বিল্লাহ ফারদিন ওরফে রাজু নামেও পরিচিত।


বিজ্ঞাপন


রাজধানীর হাজারীবাগে এক নিঃসন্তান দম্পতি আড়াই বছর বয়স থেকে রাজুকে লালন-পালন করেন। কিশোর বয়সে নানা অপরাধে জড়ানোর পর বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি। ২০১৩ সালের পর প্রতারণা মামলায় একাধিকবার গ্রেফতার হন রাজু। তবে জামিনে বের হয়ে আবার প্রতারণা শুরু করেন।

পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে নওগাঁয় অর্থ আত্মসাৎ করতে গিয়ে ধরা পড়েন রাজু। পড়াশোনা খুব বেশি না করলেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন বলে প্রচার করতেন। পরিবারের ইতিহাস ও নাম বদলে মাসুম বিল্লাহ ফারদিন বলে পরিচয় দিতেন। নিজের আগের পরিচয় লুকাতে অন্য এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে রাজু তার ছবি বসিয়েছিলেন। হোটেলে হোটেলে ছিল তার বসবাস। এরই মধ্যে একাধিক তরুণী প্রতারণার শিকার হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। এরপরই রাজুকে গ্রেফতার করে দুই দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, রাজু প্রথমে দাবি করেন, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এরপর দাবি করেন, টেনেটুনে এসএসসি পাস করেছেন। নিজের গ্রামের বাড়ি ও মা-বাবার আসল পরিচয় সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এরপর রাজুকে যে দম্পতি লালন-পালন করেছেন, তাদের খোঁজে নামেন গোয়েন্দারা। ডিবি কার্যালয়ে ওই দম্পতিকে ডেকে আনা হয়। তারা জানিয়েছেন, কৈশোর থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ায় রাজুকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

raju3

এমপি রহমত আলীর ছেলে জামিল হাসান দুর্জয় বলেন, আমরা দুই ভাই ও এক বোন। বড় ভাই জাহিদ হাসান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বোন রোমানা আলী টুসি সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি। রাজু নামে আমাদের কোনো ভাই নেই। আমাদের পরিবারের সদস্য পরিচয়ে প্রতারণার বিষয়টি জানার পর পুলিশকে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন ভুয়া পরিচয়ে ফেসবুক আইডি অলঙ্কৃত করে সুন্দরী মেয়েদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেন ফারদিন। মেয়েদের আকৃষ্ট করতে ফেসবুকে চার লাখ ফলোয়ার বানান। কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে সাড়া দিলেই হাই/হ্যালো শুরু করে নিজেকে সাবেক এমপি রহমত আলীর দ্বিতীয় ঘরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতেন। এছাড়াও প্রেমের ফাঁদে ফেলতে মেয়েদের দামি গিফট পাঠাতেন। কেউ প্রেমের ফাঁদে পা দিলে নিয়মিত পাঁচতারকা হোটেলে লাঞ্চ ও ডিনারের জন্য নিয়ে যেতেন। শপিং করে দিতেন নামিদামি শপিংমল থেকে। ধনাঢ্যদের বউদের পরকীয়ার ফাঁদে ফেলে নিয়মিত সিসা বার ও স্পা সেন্টারে গিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় কাপল স্পা নিতেন। কখনও কখনও ঘুরতে নিয়ে হোটেল ও রিসোর্টে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাতেন ফারদিন। এরপরই সুকৌশলে প্রতারণা শুরু করতেন তিনি।

এছাড়াও বিদেশে পাঠানো, সরকারি চাকরি দেওয়া ও বদলির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। এজন্য তিনি বিভিন্ন সরকারি দফতরের কাগজপত্র ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করে সফটওয়্যারের মাধ্যমে এডিট করে নিজের নামের সঙ্গে পছন্দের পদবী বসিয়ে ভিকটিমদের মেসেঞ্জার ও ওয়াটসআপে পাঠাতেন।

ডিবি জানায়, শুধু এমপির ছেলে হিসেবে নয়, ফারদিন নিজেকে মন্ত্রীর ভাই, কণ্ঠশিল্পী, পুলিশের স্বামী, সেনা কর্মকর্তার স্বামী, ট্যুরিজম বোর্ডের এক্সিকিউটিভ, বিপিএলের ফ্রাঞ্চাইজি ফরচুন বরিশালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের যুগ্ম মহাসচিব, একটি পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ চেম্বার অফ কমার্সের সদস্যসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণা করেছেন।

ফারদিনের বিরুদ্ধে গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় (নম্বর-২) এক ভুক্তভোগী নারী উল্লেখ করেন, ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ফারদিন তাকে বড় বোন বানিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। একপর্যায়ে ফারদিন নিজেকে এমপির ছেলে পরিচয় দিয়ে জাইকা প্রজেক্টের আওতায় জাপান পাঠানোর কথা বলে ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

raju4

ফারদিনের প্রতারণার বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফুল্লাহ বলেন, আড়াই বছর বয়স থেকে হাজারীবাগের এক নিঃসন্তান পরিবারে বেড়ে ওঠা ফারদিন মাত্র ১২ বছর বয়সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম নওগাঁ সদর থানার একটি প্রতারণা মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। এরপর বিভিন্ন পরিচয়ে নারীদের সঙ্গে প্রেম-পরকীয়ার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করতে থাকেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন প্রতারণায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বিষয়টি আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

ফেসবুকে যেসব পরিচয় দিতেন রাজু

এমডি বিল্লাল ফারদিন নামের ফেসবুক আইডি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তার ফেসবুক প্রোফাইলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে ছিলেন বলে দাবি করতেন। তার ফেসবুকে গিয়ে দেখা গেল, তিনি ফরচুন বরিশালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছাড়াও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মিডিয়া অ্যাম্বাসাডর, রয়েল ডাচ মেডিকেল কলেজের পরিচালক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সদস্য, আইনি সহায়তা কেন্দ্র আসক ফাউন্ডেশনের সদস্য, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, চিটাগং ক্লাব লিমিটেডের নির্বাহী সদস্য, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র চট্টগ্রামের সদস্য, দৈনিক গণকণ্ঠের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব, দি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া অ্যাম্বাসাডর, এফবিসিসিআইর সদস্য, আবাহনী ক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, হবিগঞ্জের গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেলের পরিচালক, রহমতুল্লাহ ট্যানারির প্রধান নির্বাহী, বাটারফ্লাই পার্ক বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যাম্বাসাডর, চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের সদস্য, জেসিআই মানিকগঞ্জের পরিচালক, সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ও ঢাকা সিপি রেড ক্রিসেন্ট ইয়ুথের আজীবন সদস্য।

কেআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর