সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘ডিসেম্বর’ কেড়ে নিল রোহানের বাবা-মাকে, রুবিনার পরিবারে চাপা কষ্ট

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:২০ এএম

শেয়ার করুন:

‘ডিসেম্বর’ কেড়ে নিল রোহানের বাবা-মাকে, রুবিনার পরিবারে চাপা কষ্ট

আরাফাত রহমান রোহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় প্রাইভেটকারের নিচে প্রাণ হারানো রুবিনা আক্তারের ছেলে। ১৪ বছর বয়সী এই কিশোরের কাছে একটি বিভীষিকাময় মাসের নাম ডিসেম্বর। গত বছরের ২২ ডিসেম্বরে হারিয়েছেন বাবাকে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার বাবা মাহবুবুর রহমানের। এরপর থেকে মা রুবিনা আক্তারকে ঘিরেই তার পৃথিবী। বছর ঘুরে আবারও এসেছে ডিসেম্বর। তবে এবারের ডিসেম্বরটা যেন আরও ভয়ঙ্কর ‍রূপে ফিরে এলো তার জীবনে। কেড়ে নিলো বেঁচে থাকার অবলম্বর সেই মাকেও।

গত শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) ছুটির দিন ওই দুর্ঘটনার পর ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে রুবিনার লাশ প্রথমে স্বামীর বাড়ি তেজগাঁওয়ে নেওয়া হয়। সেখান থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়িতে নিয়ে বাদ মাগরিব জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সেদিন দুর্ঘটনা কবলিত প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত শিক্ষক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহ। রুবিনার এবং আশপাশের মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচিতেও গাড়ি থামাননি নৈতিক স্খলনের দায়ে বহিষ্কার হওয়া ঢাবির ওই শিক্ষক। বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাফর শাহকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


সবই যেন আছে তবুও কি যেন নেই রুবিনার পরিবারে। দু’দিন আগেও যে মানুষটি হাসতে হাসতে বাবার বাড়ি আসছিল। আজ সে লাশ হয়ে শুয়ে আছে কবরে। একটা চাপা কষ্ট বিরাজ করছে রুবিনার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মধ্যই। যা মুখ ফুটে বলতেও পারছেন না। কিছু জানতে চাইলেই হু হু করে কেঁদে উঠছেন।

এদিকে বাবার পর মাকে হারিয়ে স্তব্ধ রোহান। দু’-চোখে শুধু পানি ঝরছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের মৃত্যুতে কে তাকে সান্ত্বনা দেবে আর কিইবা সান্ত্বনা দেবে। এজন্য রোহানের কান্নাও যেন থামছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনেও এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। নিহত রুবিনার স্বজনদের কান্নাও যেন থামছিল না।  

অন্যদিকে রুবিনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে আছে সবকিছু। তার হাতে সাজানো-গোছানো সংসার পড়ে আছে, নেই শুধু তিনি। তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলির ৭৫/২ স্বামীর বাড়িতে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া একমাত্র ছেলে রোহানকে নিয়ে থাকতেন তিনি। স্বামী মাহবুবুর রহমানের মৃত্যুর পর কিছুটা একা হয়ে গেলেও বাবা ও শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে সময় কাটতো তার। বাড়ি ভাড়া ও স্বজনদের সহযোগিতায় ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্বামীকে হারান রুবিনা। রুবিনা আক্তারের ভাই জাকির হোসেন মিলন বলেন, আমরা পাঁচ বোন দুই ভাই। রুবিনা ভাই-বোনের মধ্যে ৬ নম্বর ছিল। প্রতি শুক্রবার সে আমাদের বাসায় চলে আসতো। আমরা সব ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে আড্ডা দিতাম। আমি সব ভাই বোনের প্রিয় ছিলাম। সবাই আমাকে দেখতে ছুটে আসতো। এখন আমার বোন আর আসবে না। আমার মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি সবার অভিভাবক ছিলাম। ঘটনার দিনে দুপুরে আমাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়ার কথা ছিল। প্রতিবার সে চলে যাওয়ার সময় আমি বোনের ছেলের জন্য অনেককিছু কিনে দিতাম। আমার বোনটা একদম সবার চেয়ে ভিন্ন ছিল। অনেক সহজ সরল ছিল। তার মনে কোনো অহংকার ছিল না। সে হোম ইকোনোমিক্স কলেজে পড়াশোনা করেছে। তাকে কোনোদিন আমরা বাসা থেকে একা ছাড়তাম না। 


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, সে কোনোকিছু তেমন চিনতো না। ছেলেটাও তার মতো সরল-সোজা হয়েছে। ঢাকায় বড় হলেও এই বাসা থেকে ওই বাসা চেনে না। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। গাড়িটি থামালে আমার বোন বেঁচে যেত। এভাবে তার মৃত্যু হতো না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পরেই আমার ভাগ্নে রোহানকে তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। না হলে ও একা ওই বাসায় কী করবে। নিয়ে আসার পরে শুধু কান্না করছে বসে বসে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাকির হোসেন বলেন, সবার ভালোবাসা পেলেও মায়ের ভালোবাসা তো আর পাবে না রোহান। একদম চুপ হয়ে গেছে। কোনো কথা বলে না। এত ছোট বয়সে গত বছরে বাবাকে হারিয়েছে, এখন মাকে হারালো। তার তো আর কেউ রইলো না। 

রুবিনার বোন সুলতানা লিপি বলেন, প্রতিদিন বোনের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। সে আর ফোন দেবে না, আর কখনো জিজ্ঞেস করবে না ওষুধ খেয়েছি কি না। মারা যাওয়ার এক দিন আগে ফোন দিয়ে বলতেছে, কখনো আমার কিছু হয়ে গেলে তোমরা ছেলেটিকে দেখে রেখো। ৩টার দিকে আমার মেঝো আপু আমাকে ফোন দিয়ে বলে রুবি এক্সিডেন্ট করেছে। তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এরপর শুনতে পাই বোনের মৃত্যুর খবর। 

তিনি আরও বলেন, আমি রাস্তায় গিয়ে দেখে এসেছি আমার বোনের রক্ত। এর কী কোনো বিচার হবে না? আমার বাবা রক্ত দিয়ে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন। আমি হাসপাতালে গিয়ে বোনের চেহারা চিনতে পারিনি। আমার বোনের চেহারা রক্তে ভরা ছিল। মুখে রক্ত জমে কালো হয়ে গিয়েছিল। আমার বোন হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। ওই চালকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

রুবিনার ননদ আবিদা সুলতানা ডলি বলেন, রুবিনা খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। সে আমার সঙ্গেই থাকতো। আমরা যৌথ পরিবার হিসেবে ছিলাম। প্রতি সপ্তাহে বাবার বাড়িতে যেতেন। তবে সেখানে বেশি সময় থাকতেন না। আর কোথাও একা যেতেন না সঙ্গে কেউ না কেউ থাকতো। তার বাবার বাসায় যাওয়ার সময় আমার স্বামী নুরুল আমিনকে নিয়ে যেত আবার নিয়ে আসতো। খুবই ভালো মানুষ ছিল। 

রোহানের খালা রোকসানা আক্তার জানান, রোহান তেজগাঁও ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত বছর করোনায় তার বাবা মাহবুবুর রহমান ডলারের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলিতে স্বামীর বাড়িতেই থাকতেন রুবিনা। বাড়ি ভাড়া ও স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া সহযোগিতায় ছেলেকে নিয়ে দিন কাটছিল তার। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি। কিন্তু এখন ছেলেটার কী হবে? মায়ের অভাব তো আর কিছু দিয়ে পূরণ করা যাবে না। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘এত মানুষের ডাকাডাকির পরও কেন তিনি গাড়ি থামাননি, আমার জানা নেই। উনি কি আসলেই দেখেননি! লুকিং গ্লাসে তাকালেই কিন্তু উনি ওই নারীকে দেখতে পেতেন। আমি বলব, এটা হত্যাকাণ্ড।’

উল্লেখ্য, শুক্রবার রুবিনার ননদের স্বামী নুরুল আমিনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে আসামাত্র একটি প্রাইভেটকার তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে ছিটকে ওই গাড়ির সামনে পড়ে যান রুবিনা। আর রাস্তার পাশে তার বোন জামাইও পড়ে যান। কিন্তু গাড়ির সামনে রুবিনা পড়লেও চালক গাড়ি না থামিয়ে চালাতে শুরু করেন। এতে করে রুবিনার ওড়না গাড়ির চাকার সঙ্গে পেঁচিয়ে আটকা পড়ে যান। এভাবে ওই গাড়িচালক আটকে পড়া রুবিনাকে নিয়েই টিএসসি মোড় হয়ে নীলক্ষেতের দিকে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকেন। আর তার পেছনে পেছনে প্রত্যক্ষদর্শীরা ছুটতে থাকেন। পরে নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ থেকে পলাশী অভিমুখী সড়কের মুখে চালককে আটকে রুবিনাকে উদ্ধার করেন পথচারীরা। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ডব্লিউএইচ/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর