যানজটের শহরে ক্ষণে ক্ষণে হাঁপিয়ে উঠছেন নগরবাসী। শীত শেষে শুরু হওয়া গরমে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজতে নাগরিকরা ভিড় করছেন পথের পাশের কোমল পানীয়ের দোকান ও ছোট-মাঝারি রেস্তোরাঁয়। এসব দোকানে বিক্রি হওয়া পানীয়তে তৃষ্ণা মিটলেও অনেককে পড়তে হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। কারণ পানীয় ঠান্ডা করতে দোকানিরা যে বরফ ব্যবহার করছেন সেগুলোর বেশিরভাগ মাছের জন্য তৈরি বরফ বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
প্রকৃতিতে গরম পড়তেই ঢাকার সড়কে দৃশ্যমান হয়েছে আঁখের রস, আইসক্রিম, শরবত। ছোট ও মাঝারি মানের রেস্তোরাঁয় লাচ্ছি-ফালুদা বিক্রির হিড়িক পড়েছে। এসব দোকানে পানীয় ঠান্ডা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বরফ। আর সে বরফ আসে নগরীর বিভিন্ন বরফকল থেকে।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর গাবতলি স্লুইজ গেট এলাকার বরফ কল, মোহাম্মদপুর টাউন হল বিহারী ক্যাম্পের বরফ কল, বাঁশবাড়ি, রায়েরবাজারসহ বেশ কয়েকটি বরফ কল ঘুরে যে তথ্য মিলিছে, তা জানলে পিলে চমকে ওঠার মতো।
কল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা খাওয়ার জন্য বরফ তৈরি করেন না। তাদের কলে যে বরফ তৈরি হয়, তা মূলত মাছ সংরক্ষণের জন্য। আর এই বরফ তৈরিতে তারা সরাসরি ঢাকা ওয়াসার পানি ব্যবহার করেন।
গাবতলি স্লুইজ গেট এলাকায় এক যুগ ধরে বরফ কল চালান আব্দুর রহিম। সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ নামের বরফ কলটি ঘুরে দেখা যায়, নোংরা পরিবেশেই তৈরি হচ্ছে বরফ। তৈরি বরফের খণ্ড ফেলে রাখা হয়েছে নোংরা মেঝেতে।
কারণ জানতে চাইলে আব্দুর রহিম বলেন, 'মাছের বরফ পরিষ্কার রাইখা কি করবেন? কাচা মাছ কি ধুইবেন না?'
বিজ্ঞাপন
আব্দুর রহিমের ভাষ্য, তিনি খাবার জন্য বরফ তৈরি করেন না। তার বরফকলে শুধুমাত্র ওয়াসার সরাসরি পানির সংযোগ আছে। সে পানি দিয়ে তৈরি হয় মাছ বাজারে মাছ সংরক্ষণের বরফ।
বরফকল থেকে বরফ নিয়ে তা রেস্তোরাঁ, পথের পাশের খাবার দোকানে ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রহিম বলেন, 'আমার এখানে অনেক বাজার থেকে লোক আসে। কে মালিক, কে কর্মচারী জানি না। আবার কেউ যদি মাছের নামে বরফ নিয়ে কাউরে খাওয়ায়, এই দোষ তো আমার না। আমি তো খাওয়ার বরফ বানাই না।'
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বরফ কলটির একজন শ্রমিক ঢাকা মেইলকে জানান, গাবতলি দ্বীপনগর, হাড্ডিপট্টি, ঢাকা উদ্যান, আদাবর এলাকার আইসক্রিম ও শরবত বিক্রেতাদের একটি বড় অংশ এ কলের খদ্দের। তবে ওই খদ্দেররা মাছের নামেই বরফ কেনেন।
একই তথ্য জানিয়েছেন মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকার বরফকল মালিক টাইসন মাসুম। ঢাকা মেইলকে তিনি জানান, তার বরফ কলে এক ধরণের বরফ তৈরি হয়। তা শুধু মাছে ব্যবহারযোগ্য। মাছ ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিগতভাবে মাছ সংরক্ষণের জন্যই খদ্দেররা বরফ কিনে থাকেন।
মাসুম বলেন, 'আপনি যদি আমার কাছে বরফ নিতে আসেন, আমি কি না করব? কিন্তু এটা খাওয়ার বরফ না। মাছে দেওয়ার বরফ। সরাসরি ওয়াসার লাইনের অয়ানি দিয়ে তৈরি করি। এটা আমরা সবাইকেই বলে দেই। আর তৈরি বরফ ফ্লোরে রাখি। এটা একটা সংকেত যে, এটা খাওয়ার জন্য না।'
একই ধরণের তথ্য মিলেছে মোহাম্মদপুরের টাউন হল ক্যাম্পের বরফ কল, বসিলা বরফ কল ও মিরপুর ১ নম্বর এলাকার বরফ কল থেকে। এসব বরফ কলে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয় দৈর্ঘ্যে ৩৪ ইঞ্চি, প্রস্থ্যে ১৪ ইঞ্চি ও পুরুত্বে সাড়ে চার ইঞ্চি আকারের একেকটি বরফ।
সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ওয়াসার 'সোর্স পয়েন্ট' এর পানি নিরাপদ এবং পানযোগ্য। কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কে কিছুটা সমস্যা আছে। চলমান ডিস্ট্রিক্ট মিটার এরিয়া বা ডিএমএ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে এ সমস্যা থাকবে না। তবে নাগরিকদের নিশ্চয়তার জন্য পানি ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকান, আইসক্রিমের দোকান, আখের রসের পাশাপাশি এ বরফ ব্যবহার হচ্ছে ছোট- মাঝারি আকারের জুস বার ও রেস্তোরাঁয়।
মিরপুর বাজার রোড, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, টাউন হল বাজার, নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার অধিকাংশ জুস ও লাচ্ছি বিক্রেতাদের নিজস্ব বরফ তৈরির ব্যবস্থা নেই৷ তারা বাইরে থেকে বরফ কিনে আনেন।
কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের বিপরীতের অবাঙালি ক্যাম্পের বরফকল থেকে টাউন হল মাছের বাজারে বরফ সরবরাহ করা হয়। ওই একই বরফ যায়, টাউন হল বাজারের জুসবার ও লাচ্ছির দোকান, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের জুসবার ও লাচ্ছির দোকানে।
মিরপুর মাজার রোড, লালকুটি ও আশপাশের হোটেল রেস্তোরাঁ ও জুসের দোকানে বরফ নেওয়া হয় স্থানীয় বরফ কল থেকে।
বিষয়টিকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. নজরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে জানান, এ ধরণের বরফ পান করলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।
নজরুল ইসলাম বলেন, 'বরফ কলগুলোতে মাছের জন্যই বরফ তৈরি করা হয়। কিন্তু রাস্তার পাশে যারা খাবার বিক্রি করেন, যেমন আখের রস, বিভিন্ন শরবত, তারা ওই বরফটাকে ব্যবহার করেন। বরফকলে সরাসরি ওয়াসার ট্যাপ থেকে পানি ব্যবহার করে বরফ তৈরি করা হয়। নোংরা পরিবেশে ফেকে রাখা হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।'
কারই/এমআর

