জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কৃষি উদ্যোক্তা দুরন্ত বিপ্লবের মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। কিন্তু সেই সকল প্রশ্নের উত্তর অবশেষে খুঁজে দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। টানা পাঁচদিনের তদন্ত ও বিভিন্ন স্থান এবং একটি জাহাজের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে বেরিয়ে এসেছে আসল ঘটনা। ফলে তার মৃত্যুর ১২ দিন পর দুরন্ত বিপ্লবের মৃত্যুর নেপথ্যের কারণ জানা গেল।
সোয়ারীঘাটে ছদ্মবেশে চারদিন:
বিজ্ঞাপন
বিপ্লবের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধারের পর প্রশ্ন ওঠে, কে তাকে এমনভাবে হত্যা করল? নেপথ্যে কারা। তাছাড়াও তার লাশ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও জানিয়েছিলেন, তার মৃত্যু বুকে ও মাথায় আঘাত করার কারণেই হয়েছে। ফলে নেপথ্যের কারণ সুক্ষ্মভাবে খুঁজে বের করতে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে ছায়া তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইকে। টানা চারদিন বুড়িগঙ্গার সোয়ারীঘাট এলাকায় মাঠ চষে বেরিয়েছেন দক্ষ তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার এসআই সালেহ ইমরান। এসময় তাকে নানা ছদ্মবেশও ধারণ করতে হয়েছিল। কথা বলতে হয়েছে ঘাটের বিভিন্ন নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে ফেরীওয়ালা ও সাধারণ যাত্রী এমনকি এলাকাবাসীর সঙ্গেও। সোয়ারীঘাট এলাকায় চারদিন থাকার শেষ দিনে তিনি জানতে পারেন, সেই ঘাটে গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যার আগে একটি নৌকা ডুবির দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আর সেই নৌকায় থাকা একজন ব্যক্তি নিখোঁজ হন। এক পর্যায়ে জানতে পারেন, ঘটনার দিন মর্নিং সান-৫ নামের একটি জাহাজ বটতলা থেকে সোয়ারীঘাটগামী একটি নৌকাকে ধাক্কা দিলে সেটি ডুবে যায় এবং এক যাত্রী নিখোঁজ হন।

যেভাবে বেরিয়ে এলো আসল ঘটনা:
নৌকাটিকে ধাক্কা দেওয়ার তথ্য পাওয়ার পর আলো দেখতে পায় পিবিআই। তারা খুঁজতে থাকেন দুর্ঘটনার ফুটেজ। জানতে পারেন, সেই নৌকাকে ধাক্কা দেওয়া মর্নিং সান-৫ এর পেছনে সেদিন ছিল পারাবত-১৫ নামের আরেকটি লঞ্চ। এবার সেই লঞ্চকে খুঁজে বের করেন তারা। সেটিতে ভাগ্যক্রমে পাওয়া যায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। সেই ফুটেজে ওঠে আসে কিভাবে নৌকাটিকে ধাক্কা দেওয়া হচ্ছিল। এরপর কী ঘটেছিল? বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় বিপ্লবের মৃত্যুটি খুন নয়, লঞ্চের ধাক্কায়। নৌকা ডুবিতে পানিতে পড়ে সাঁতার না জানায় তার মৃত্যু হয়।
বিজ্ঞাপন
পিবিআই জানায়, গত ৭ নভেম্বর বিপ্লব বিকেল ৪টা ৪৭ মিনিটে কেরানীগঞ্জের বড় বাকতারে থাকা তার নিজস্ব খামার থেকে বের হন। এরপর তিনি কদমতলী হয়ে নূর ফিলিং স্টেশনের সামনে দিয়ে পায়ে হেঁটে কোনাখোলা যান। সেখানে বিল্লাল নামের এক পূর্বপরিচিত ব্যক্তির অটোরিকশায় ওঠেন। যা নূর ফিলিং স্টেশনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়েছে। এরপর তিনি ৪টা ৫৫ মিনিটে কোনাখোলা থেকে রওনা দিয়ে ৫টা ১৭ মিনিটে জিঞ্জিরা ফেরিঘাটে পৌঁছান। এরপর তিনি ওই নৌকায় ওঠেন সোয়ারীঘাট যাওয়ার জন্য। তার সঙ্গে ছিল আরও চার যাত্রী। নদী পারাপারের সময় তীরে ভেড়ার আগে মর্নিংসান-৫ নামের একটি লঞ্চ তাকে বহনকারী নৌকাটিকে ধাক্কা দিলে সেটি ডুবে যায়। অন্যরা সাঁতরিয়ে তীরে ওঠেন। তাদের উদ্ধার করেন ঘাটে থাকা তিন ব্যক্তি। কিন্তু নৌকার সঙ্গে দুরন্ত বিপ্লব পানিতে তলিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে ৯ কিলোমিটার দুরে গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে মেধাবী এই ছাত্রনেতার লাশ। পরে নৌ পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। তার পরিবার খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।

পেছনের জাহাজের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ জট খুলে দিয়েছে:
মুলত পারাবত-১৫ নামের একটি লঞ্চের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ঘটনার জট খুলে দিয়েছে। সেটি না থাকলে দুরন্ত বিপ্লবের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে আরও বেগ পেতে হতো পিবিআইকে। সময়ও লাগত। যদিও সেই লঞ্চের ফুটেজটি স্পষ্ট তেমন ছিল না কিন্তু নৌকাটিকে ধাক্কা দেওয়ার দৃশ্যটি ক্যামেরায় উঠে এসেছিল। সেই ফুটেজ এখন পিবিআইয়ের হাতে।
নৌকার চালক সামসু মাঝি যা জানিয়েছে:
তার নৌকাটি বটতলা থেকে সোয়ারীঘাটে যাচ্ছিল। ঠিক মাঝামাঝি পথে নৌকাটির ডানপাশে এসে ধাক্কা দেয় লঞ্চটি। ওই সময় নৌকাটিতে বিপ্লবসহ যাত্রী ছিল ৫ জন। পরে তিনি শুনতে পারেন, এক যাত্রীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেদিন তার নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল। এরপর তিনি ভয়ে গ্রামের বাড়ি পালিয়ে যান। এই ঘটনায় ৬৫ বছর বয়সী মাঝি সামসুকে খুঁজে বের করে পুরো ঘটনা জেনেছে পিবিআই।
খোঁজ মেলেনি নৌকার যাত্রীদের:
পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান জানান, তিনি ও তার সহকর্মীরা চারদিন সোয়ারীঘাটে অনুসন্ধানে নামেন। এরপর নৌকাডুবির ঘটনাটি নিশ্চিত হয়ে তারা সেই নৌকায় থাকা যাত্রীদের খুঁজে বের করার চেষ্টাও করেন। এজন্য সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল স্ট্যাটাস। কিন্তু তাতে কেউ সাড়া দেয়নি। তিনি বলেন, হয়ত যারা যাত্রী ছিলেন তারা অল্প শিক্ষিত হয়ে থাকতে পারেন। অথবা তারা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন না। আবার এমনও হতে পারে বিষয়টি তারা জানাতে আগ্রহী হয়নি। তিনি বলেন, ঘটনাটি সেদিন ঠিক সন্ধ্যার সময় মাগরিবের আজানের আগে ঘটে। অনেকে দেখলেও কেউ জাতীয় জরুরী সেবায় একটি ফোনও করেনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ ফোন করলেই হয়ত দুরন্ত বিপ্লবকে বাঁচানো যেত।
লঞ্চের মালিকের অস্বীকার:
পিবিআই জানায়, পারাবত-১৫ লঞ্চের সামনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সূত্র ধরে খুঁজে বের করা হয় নৌকা ও ধাক্কা দেওয়া লঞ্চ মর্নিংসান-৫ কে। কিন্তু সেটির মালিক ঘটনা শুনে অস্বীকার করতে থাকেন। এরপর যখন তাকে ফুটেজ দেখানো হয়, তখন তিনি আর কোনো কথা বলেননি। তবে সেই লঞ্চের মালিক ও চালক এখন ডিবির হেফাজতে আছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে নৌকার মাঝি সামসুকে পিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনেছে।
সেই ধাক্কা দেয়া লঞ্চ মর্নিং সান-৫ জব্দ:
দুরন্ত বিপ্লবকে বহনকারী নৌকাকে ধাক্কা দেওয়া মর্নিং সান-৫ লঞ্চটিকে জব্দ করা হয়েছে। সেটি ঘটনার দিন সোয়ারীঘাটে নোঙর করা ছিল। পরে সেটি যাত্রী তোলার জন্য সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। যাওয়ার পথেই নৌকাটিকে ধাক্কা দেয়। এরপর সোজা সদরঘাটে যাত্রী তুলে সেটি চলে যায় বরিশালে। তবে বরিশাল থেকে সেই লঞ্চকে ঢাকায় এনেছে পিবিআই।

যা জানাল পিবিআই:
পিবিআই জানিয়েছে, নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর এই আলোচিত ঘটনাটির শুরু থেকে তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা জেলার পিবিআইয়ের এসআই সালেহ ইমরান। তিনি বলেন, ঘটনাটি খুঁজে বের করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। খুব সহজ ছিল না। কারণ সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল এটি হত্যা হতে পারে। সেই ধারণাকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পারাবত-১৫-এর সামনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দারুণ সহায়তা করেছে। এছাড়াও দুরন্ত বিপ্লব তার কৃষি ফার্ম থেকে বের হয়েছিলেন এবং সর্বশেষ কোথায় গিয়েছিলেন— সব ফুজেট সংগ্রহ করেছিলাম আমরা। এসব ফুটেজ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতে হয়েছে। ফলে তার ফার্ম থেকে বটতলা ঘাট যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। পরে পারাবাত লঞ্চের ফুটেজ তার মৃত্যুর কারণ আরও স্পষ্ট করেছে।
ঘটনাটির রহস্য উম্মোচণে তদন্তকারী টিমকে মনিটরিংকারী আরেক কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলার পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সাফিন মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা গত ১৩ নভেম্বর থেকে ছায়া তদন্ত শুরু করি। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি, ক্যামেরা ফুটেজ, তার গতিবিধি, পাশাপাশি নৌকাটিকে যে মর্নিং সান-৫ ধাক্কা দিয়েছিল, কারা কারা উদ্ধার করেছিল এবং স্থানীয় সাক্ষীদের তথ্যের ভিত্তিতেই এই ঘটনার নেপথ্যের কারণ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি।
এমআইকে/আরআর

