শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ফারদিন হত্যা: রহস্যের জট খুলবে কবে?

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ০৬:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ফারদিন হত্যা: রহস্যের জট খুলবে কবে?

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। ধোঁয়াশা কাটেনি এখনও। নানা প্রশ্নের উদয় হলেও সেগুলোর জটও খুলছে না। পাশাপাশি হত্যাকারীরাও এখনও শনাক্ত হননি। কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড এবং কীভাবে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলা হয়েছিল তা নিয়ে ঘোরের মধ্যে আছে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ক্ষণে ক্ষণে মিলছে নতুন সব তথ্য। মূল ও ছায়া তদন্ত সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এসব তথ্য দেওয়া হলেও শুরু থেকেই ভিন্ন ভিন্ন দাবি করে আসছে র‌্যাব ও পুলিশ। তবে তাদের কেউই এখনও আলোচিত এ ঘটনার কূলকিনারায় পৌঁছাতে পারেনি।

এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই ধরনের তথ্যে হতাশ হয়ে পড়েছেন ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা। সেই সঙ্গে তদন্তে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলেও দাবি করছেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে, র‌্যাব ও পুলিশের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের পর আবারও মামলা হতে পারে। এতে তদন্তও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে সঠিক বিচার পাওয়া কঠিন হবে বলেও মনে করছেন ফারদিনের বাবা।

Fardinঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমাদের এই বিচার ব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতার কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুই বাহিনীর এমন ভিন্ন বক্তব্যে ক্ষোভও ঝেড়েছেন তিনি। বলেন, ফারদিনকে সেখানে (চনপাড়ায়) হত্যা করা হয়েছে বলে প্রচারের জন্য যে কর্মকর্তা এমন বক্তব্য দিয়েছেন, তিনি আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। তবে ছেলের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে গিয়ে যাতে কোনো নিরপরাধ মানুষ অন্যায়ের শিকার না হন এ বিষয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এদিকে, প্রশাসনের দুই বাহিনীর ভিন্ন বক্তব্যের কারণে ফারদিন নূর পরশ হত্যাটি সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো নাটকীয় সিরিজে রূপ নেবে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কারণ হিসেবে যাদের বেশিরভাগই মনে করছেন, দেশের প্রতিটি বাহিনীর কাজের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। অনেক আলোচিত ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ৪৮ ঘণ্টা না পেরোতেই মূল হোতা ও এমনকি নেপথ্যের জড়িতরাও গ্রেফতার হয়েছে। ফলে বিগত ঘটনাগুলোতে বাহবাও কম পায়নি তারা। কিন্তু ফারদিন হত্যাকাণ্ডের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এখনও কোনো ক্লু বের করতে পারেনি র‌্যাব ও পুলিশ। অথচ তারা প্রতিদিনই নানা বক্তব্য ও দাবি করে চলেছেন।

Fardinসম্প্রতি র‌্যাব দাবি করেছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করেছে রায়হান গ্যাং। তবে বাহিনীটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রমাণ সামনে আসেনি।


বিজ্ঞাপন


র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত মঙ্গল ও বুধবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি। চনপাড়ার আশপাশে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হতে পারে। ফারদিনকে হত্যায় সরাসরি জড়িত রয়েছে রায়হান গ্যাং। তবে ফারদিন চনপাড়ায় কেন গিয়েছিল সে কারণ এখনও খুঁজে বের করতে পারেনি র‌্যাব।

এদিকে, র‌্যাবের এমন বক্তব্যের পর ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন বলেন, রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলের কী নিয়ে বিরোধ থাকবে? বুঝলাম সে (রায়হান) একটা খারাপ মানুষ। কিন্তু আমাকে বোঝান, আমার ছেলেটাই কেন তার টার্গেটে পড়বে? সে কেন ওখানে (চনপাড়ায়) যাবে? কীভাবে সম্ভব সেটা! কোন তথ্যের ভিত্তিতে দেখাবেন সেখানে আমার ছেলেটা মুভ করেছে? সে যদি সেখানে না থেকে থাকে তাহলে এসব বলার অর্থ কী?’

Fardinঅন্যদিকে, র‌্যাবের মিডিয়া বিভাগের পরিচালকের বক্তব্যের পরদিন বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ফারদিনের মুঠোফোন নম্বরের সর্বশেষ অবস্থান ছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোড়ে। তখন ঘড়ির কাটায় ছিল রাত ২টা ৩০ মিনিট। ফলে ওই সময় নারায়ণগঞ্জের চনপাড়ায় তার কোনোভাবে থাকার কথা নয়।

এর কারণ হিসেবে ডিবির প্রধান যুক্তি দেখিয়েছেন, যাত্রাবাড়ী থেকে চনপাড়ার যে দূরত্ব তাতে সেখানে পৌঁছাতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। কোনোভাবে ঘটনার রাতে ওই অল্প সময়ে ফারদিন চনপাড়ায় যায়নি বলেও দাবি করেছে ডিবি।

এদিকে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়ার দাবি করেছে ডিবি। ইতোমধ্যেই সেই ভিডিও ফুটেজ গণমাধ্যমেও সরবরাহ করা হয়েছে।

ওই ফুটেজে দেখা যায়, ফারদিন ঘটনার রাতে ২টা ৩০ মিনিটের দিকে যাত্রাবাড়ীর লেগুনা স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। সেখানে যাওয়ার পর সাদা টি-শার্ট পরিহিত এক যুবকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় তাকে। এরপর তিনি একটি লেগুনায় ওঠে বসেন। ওই সময় লেগুনার পাশে থাকা যুবককে হাতে থাকা একটি সাদা কাগজ নিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশে হাঁটতে দেখা যাচ্ছিলে। এছাড়া ফরদিন যে লেগুনায় উঠে বসেন সেটিতে চারজন বসা ছিল। একপর্যায়ে লেগুনাটি তারাবো বিশ্বরোডের দিকে চলে যায়। তবে সিসিটিভি ফুটেজে ডিবি যাকে ফারদিন বলে দাবি করেছে, সেখানে কারও চেহারা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি। ফলে তাদের ভিডিও সঠিক কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

তবে ওই ফুটেজের সূত্র ধরে ডিবির প্রধান হারুন বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে তারাবো যেতে ফারদিনের সর্বোচ্চ ২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। সেখান থেকে চনপাড়ায় যেতে হলে তাকে প্রথমে কোনাপাড়া যেতে হবে। এরপর নদী পার হয়ে যেতে হবে চনপাড়ায়। ফারদিন যে লেগুনায় উঠেছিল, সেটিসহ ওই লেগুনার চালক আমাদের নজরদারিতে আছে। আমরা তাদের সঙ্গে আরও কথা বলব।

>> আরও পড়ুন: জীবনে সিগারেটও স্পর্শ করেনি ফারদিন, চনপাড়ার গল্প ‘কাল্পনিক’

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রের বরাতে বলা হয়েছিল, ফারদিন চনপাড়ায় মাদক কিনতে গিয়েছিলেন। সেখানে মাদক কারবারিদের সঙ্গে তার দরদাম নিয়ে ঝামেলার একপর্যায় তারা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বলেও ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল।

Fardinএই প্রতিবেদন প্রকাশের দুইদিন পর ডিবির প্রধান হারুন এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ফারদিনকে মাদকঘটিত কারণে হত্যা করা হয়েছে, এই তথ্যটি সঠিক নয়। তবে তাকে ঢাকার কোনো একজায়গায় হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেই জায়গাটি কোথায় তা সেদিন স্পষ্ট করতে পারেননি তিনি।

ফারদিন হত্যাকাণ্ডের মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশের কাছেই ছিল। শুরু থেকে সেটির ছায়াতদন্ত করছিল ডিবি। পাশাপাশি কাজ করছে র‌্যাব। একই সঙ্গে দুই বাহিনীর তদন্তে পৃথক বক্তব্য বাসায় তদন্ত ব্যাহত হতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, র‌্যাব ও  ডিবি পৃথকভাবে ফারদিনের বাবাকে তাদের কার্যালয়ে ডেকেছিল। তারা তাকে ফারদিনের ছাত্রজীবন, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার রুটিন, মাদক বা নেশা করতো কি-না, কারও সঙ্গে তার শত্রুতা ছিল কি-না এবং সে কোন কোন জায়গায় যেত ও কাদের সঙ্গে মিশত এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

উল্লেখ্য, গত ৫ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন। ওইদিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা নূর উদ্দিন। নিখোঁজের দুদিন পর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূর পরশের লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। পরে লাশের ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

সবশেষ ৯ নভেম্বর মধ্যরাতে নিহতের বাবা বাদী হয়ে রামপুরা থানায় একজনের নাম উল্লেখ করে বাকীদের অজ্ঞাত দেখিয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় গত ১০ নভেম্বর ফারদিনের বান্ধবী বুশরাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পরে আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এমআইকে/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর