শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নুরের ইয়াবায় এক বছর ধরে সৌদির জেলে বাশার

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৮ মার্চ ২০২২, ১২:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

নুরের ইয়াবায় এক বছর ধরে সৌদির জেলে বাশার
আবুল বাশার (বামে) ও নুর মোহাম্মদ (ডানে)

‘আমার টাকা নাই, গরিব বইলা মন্ত্রণালয় গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমার বাচ্চাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব? আমি কী খাব? আমাকে একটা চাকরি দেন। আমার দুখের কথা কার কাছে বলব? বিমানবন্দরের অসচেতনতার কারণে আমার স্বামীর আজকের এই অবস্থা। যে প্রতিষ্ঠান থেকে আমার এত বড় ক্ষতি হলো সেখানে আমার একটা চাকরি ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। আমি যাতে বাচ্চাটাকে নিয়ে বাঁচতে পারি। আর কতদিন আত্মীয়জনের বাসায় ঘুরবো।’

সোমবার দুপুরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা মেইলকে কথাগুলো বলছিলেন সৌদি আরবে ইয়াবাসহ আটক হয়ে কারাগারে থাকা প্রবাসী আবুল বাশারের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন।


বিজ্ঞাপন


বাশারের স্ত্রী রাবেয়া জানান, তার স্বামী আবুল বাশার ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেশে আসেন। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় গত বছরের ১১ মার্চ আবারও সৌদিতে যাচ্ছিলেন। বিমাবন্দরে সৌদি যাওয়ার আগে আবুল বাশারের কাছে এসে পরিচ্ছন্ন কর্মী নুর মোহাম্মদ একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলেন, সেটিতে আচার আছে। এরপর তা সৌদিতে থাকা তার ভাইকে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু বাশার সেটি নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এক পর্যায় তাকে বিমানে উঠতেই দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেন পরিচ্ছন্ন কর্মী নুর মোহাম্মদ। এরপর জোর করে বাশারের ব্যাগে সেই প্যাকেটটি ভরিয়ে দেন। বাশার সেই প্যাকেটে কী ছিল জানতেন না। সৌদিতে পৌঁছালে তাকে আটক করে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। পরে সেটা খুলে দেখা যায় তাতে ইয়াবা। এই ঘটনায় মাদকের মামলায় সৌদি আরবের একটি আদালত বাশারকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবুল বাশারের বিষয়টি তার পরিবার জানতে পারে মাসখানেক পর। এরপর প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানায় তারা। এরপর সিসি টিভির ফুটেজ দেখে বিমানবন্দর থানা পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকায় পরিচ্ছন্ন কর্মী নুর মোহাম্মদকে গ্রেফতার করে। তিনি বিমানবন্দরের একে ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতেন। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার তিন দিন পরই জামিন বেরিয়ে আসেন তিনি। এখন সেই নুরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

শুধু তাই নয়, আলোচিত আবুল বাশারের ব্যাগে জোর করে আচারের নামে ইয়াবার প্যাকেট ঢুকিয়ে দেওয়া পরিচ্ছন্ন কর্মী নুর মোহাম্মদের সংশ্লিষ্টতা পায়নি জানিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ।

সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নুর মোহাম্মদ সেদিন আবুল বাশারকে কী দিচ্ছেন সেটি স্পষ্ট নয়। তবে তিনি কী যেন একটা নাড়াচাড়া করছিলেন। এছাড়াও আসামি তার অপরাধ স্বীকার করেননি। 


বিজ্ঞাপন


পুলিশের এমন প্রতিবেদনের ফলে নুর মোহাম্মদ সহজেই মুক্তি পেয়ে যাবেন বলে মনে করছেন বাশারের স্ত্রী। আলোচিত এ ঘটনায় পুলিশের দায়সারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়টি জানার পর বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আবুল বাশারের স্ত্রী। তিনি উল্টো আদালতে নারাজি দিয়েছেন। এ ঘটনায় বাশারের স্ত্রী প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে বছরখানেক ধরে ঘুরলেও তেমন কোনো ফলাফল পাননি বলে অভিযোগ।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনকে একাধিকবার ফোন ও বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।  এ ছাড়াও বিষয়টি জানতে প্রবাসী মন্ত্রী ইমরান আহমেদকে কল করা হয়েছিল। তিনিও সাড়া দেননি।

বিষয়টির সুষ্ঠু একটা সমাধান ও স্বামীর মুক্তি চান আবুল বাশারের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার স্বামী  নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও কেন জেল খাটবে। নুর মোহাম্মদ আমার স্বামীকে ফাঁসিয়ে দিল। গ্রেফতার হওয়ার তিন দিনের মাথায় জামিনে বেরিয়ে এলো আর আমার স্বামী সৌদিতে জেল খাটছে। আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আমি একমাত্র বাচ্চাকে নিয়ে কীভাবে থাকব। কেউ আমার খোঁজ নিল না। মন্ত্রণালয় কোনো খোঁজ নিল না, কীভাবে আছি, কীভাবে চলছি তাও জানার চেষ্টা করল না তারা।’

তিনি অভিযোগ করেন, এ বিষয়ে তিনি আপডেট জানার জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে ধর্ণা দিলেও এখন কেউ তাকে পাত্তা দেন না। ফলে তার স্বামীর মুক্তি আদৌ মিলবে কি না তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। বিষয়টির জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে বিমানবন্দর থানার এসআই মাহবুব হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, এ ঘটনায় ভিডিও দেখার পরে তদন্তে কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি। নূর মোহাম্মদ সেদিন আবুল বাশারকে কী দিচ্ছিলেন সেটা স্পষ্ট না। ফলে এসব বিষয় উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

এসআই বলেন, আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, বাশারকে তিনি প্যাকেটটি দেওয়ার জন্য কোনো জোর করেননি। এছাড়াও ওই প্যাকেটে তিনি কোনো ইয়াবা দেননি বলে দাবি করেছেন। এ কারণে এসব বিষয় উল্লেখ করেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর আবুল বাশারের স্ত্রী নারাজি দিয়েছেন। ‌এখন সেই মামলা তদন্ত করছে পিবিআই।

wife
বাশারের জন্য অপেক্ষায় স্ত্রী ও সন্তান

 

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম ও) আমিনুল ইসলাম জানান, তারা গত ২২ নভেম্বর সৌদির আদালতে আবুল বাশারের মামলাটি থেকে তাকে খালাস দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি সৌদির আদালত আবুল বাশারকে দেওয়া ২০ বছরের সাজা বহাল রেখেছে।

দূতাবাস কর্মকর্তা বলেন, বাশারের দণ্ড মওকুফের জন্য তার পক্ষে মার্জনা ভিক্ষার আবেদন করা হবে।

সন্তানকে নিয়ে অসহায় রাবেয়া

রাবেয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সৌদি আদালত তাকে একপক্ষীয়ভাবে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। সরকার ও মন্ত্রণালয় সহায়তা না করলে আমার স্বামীকে বিনা দোষেই সেখানে জেলে পচতে হবে। আমার কী হবে। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি কী করে চলবো, কোথায় যাব?’

স্বামীর এমন খবর জানার পর থেকে বিভিন্ন দফতরে ঘুরছেন রাবেয়া। গত এক বছর ধরে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের রাবেয়া ঢাকার বাড্ডা ও গাজীপুরে আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। কখনো খালার বাসায় আবার কখনো চাচাতো ভাইয়ের বাসায় একমাত্র মেয়েকে নিয়েই তার দিন কাটছে। অন্যদিকে স্বামীর রেখে যাওয়া আট লাখ টাকার ঋণের বোঝা নিয়েই চলতে হচ্ছে তাকে। চোখে মুখে সর্ষে ফুল দেখছেন তিনি। এজন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে একটি কর্মসংস্থানের আবেদন তার।

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর