ভেঙে ফেলা হচ্ছে রাজধানীর নীলক্ষেত রোড সাইড মার্কেটের (তুলা মার্কেট বা লেপ-তোশক মার্কেট) ১৪৮টি দোকান। মার্কেটটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার নকশা বহির্ভূত এসব দোকান বরাদ্দের নামে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে ভাঙা যায়নি এসব দোকান। অবশেষে দোকানগুলো ভেঙে ফেলার জন্য ৬ ও ৭ নভেম্বর অভিযান পরিচালনা করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
এরই মধ্যে অধিকাংশ দোকানিকে মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় চালাতে দেখা গেছে। যদিও দোকানিদের দাবি, সিটি করপোরেশন অনেকটা জেদের বশেই দোকানগুলো ভাঙবে। এর কারণে বিনিয়োগকারীদের মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি অনেকের ব্যবসা বন্ধেরও উপক্রম হয়েছে বলে দাবি তাদের।
বিজ্ঞাপন
এসব অবৈধ দোকান গড়ে উঠা নিয়ে ডিএসসিসির তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কিছু লোক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দোকানগুলো গড়ে তোলে (২০১২ সালে), যার নেতৃত্ব দেন দক্ষিণ সিটির সার্ভেয়ার মুহাম্মদ মুরাদ হোসেন, সৈয়দ রুমান ও কানুনগো মোহাম্মদ আলী। তারা নিজেদের পছন্দের লোকদের মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ৭৪টি ও তৃতীয় তলায় ৭৪টি মোট ১৪৮টি দোকান মাসিক প্রতি বর্গফুট ১৫ টাকা ভাড়া হিসেবে অস্থায়ী বরাদ্দ দেয়। শর্ত ছিল- বরাদ্দপ্রাপ্তরা নিজ খরচে দোকান নির্মাণ করবে। যদিও ডিএসসিসির সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত বিধিবিধান অনুযায়ী নিজ খরচে দোকান নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই।
অন্যদিকে মার্কেটের ৫০নং দোকান থেকে ৮৩/১নং দোকানের পেছনে পরিত্যক্ত জায়গা বরাদ্দের জন্য দক্ষিণ সিটির তৎকালীন প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি একেএম সামছুদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন।
১৪৮টি দোকান এবং দোকানের পেছনের পরিত্যক্ত জায়গা স্থায়ী বরাদ্দের দাবিতে এই মার্কেটের দোকান মালিক ও বর্তমান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু শাহাদাত লাবলু ২০১৩ সালে একটি মামলা করেন।
সিটি করপোরেশন বলছে, আবেদনপত্রের সাথে আগের বৈধ বরাদ্দপ্রাপ্ত নিচতলার ৩৭ জন দোকান-মালিকের নাম, সই ও ঠিকানাসহ একটি তালিকা দেয় দোকান মালিক সমিতি। ওই তালিকার প্রতিটি পৃষ্ঠার নিচে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর ছিল। নিচতলায় বরাদ্দপ্রাপ্তরা শুধু তাদের লাগোয়া দক্ষিণ পাশের পরিত্যক্ত অংশ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। বহুতল মার্কেট নির্মাণ কিংবা ওপরতলা বরাদ্দের জন্য আবেদন করেননি।
বিজ্ঞাপন
নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, দক্ষিণ পাশের পরিত্যক্ত জায়গা ও দোকানগুলোর ওপরে প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছাদ নির্মাণসহ মার্কেট সংস্কার কাজের আবেদন করা হয়। সেই সাথে আবেদন করা হয় অস্থায়ী বরাদ্দের। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনে দেওয়া দোকান মালিক সমিতির দোকান বরাদ্দের তালিকায় প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়।
ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আগের আবেদন করা ৩৭ জনের নাম পরিবর্তন করে নতুন ৭৪ জনের নাম সংযুক্ত করা হয়। আবেদনের সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় তলার কল্পিত ছাদের দোকান বরাদ্দ নম্বর ও বরাদ্দপ্রাপ্তদের একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়। এই তালিকায় আগের বৈধ বরাদ্দপ্রাপ্ত নিচতলার দোকান মালিক ৩৭ জনের স্বাক্ষরের মিল নেই। নেই নীলক্ষেত সিটি করপোরেশন মার্কেট দোকান মালিক সমিতির (দক্ষিণ) সভাপতি ও সম্পাদকের স্বাক্ষরও। এতে শুধু ডিএসসিসির সার্ভেয়ার সৈয়দ রুমান, কানুনগো মোহাম্মদ আলী ও তৎকালীন সম্পত্তি কর্মকর্তার অনুস্বাক্ষর রয়েছে।
এদিকে সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, তিনতলা মার্কেটটির নিচতলায় আছে বেডিংয়ের দোকান। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কিছু টেইলার্স, প্রেস ও কোচিং সেন্টার, যার বেশিরভাগই ভাড়া দেওয়া। মার্কেটের মালিক সমিতির কার্যালয় দোতলায়। ৪ নভেম্বর রাতে সরেজমিনে দেখা যায়- দোকানের মালামাল সরাতে ব্যস্ত দোকানিরা।
২য় তলায় কনফিডেন্স কোচিং সেন্টারে গিয়ে জানা যায়- স্থানান্তর প্রক্রিয়ার কারণে বন্ধ রয়েছে ক্লাস। কোচিং সেন্টারটির কর্তৃপক্ষ জানায়, হঠাৎ করে বলা হয়েছে ২-১ দিনের মধ্যে মার্কেট ভাঙা হবে, দ্রুত সরে যেতে হবে। অধিকাংশ দোকানির দাবি, ভাড়ার সময় মোটা অঙ্কের জামানত নেওয়া হলেও এখন জামানত ফেরত দিচ্ছেন না কোনো কোনো দোকান মালিক।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, মার্কেটটি ২০১২ সালের দিকে একতলা ছিল। সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা টিনের ছাদের ওপর কিছু দোকান বরাদ্দ দেন, যার ভিত্তি নেই। কারণ, টিনের ছাদে দোকান বরাদ্দ হয় না। এছাড়াও স্থায়ী স্থাপনার উপর সিটি করপোরেশন অস্থায়ী বরাদ্দ দেয় না। বরাদ্দের এই ফাইলও এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, গায়েব।
বর্তমান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু শাহাদাত লাবলু ঢাকা মেইলকে বলেন, হাইকোর্ট বলেছেন আমরা সবাই বৈধ। রায়ের কপি সিটি করপোরেশনে জমা দেওয়া আছে। আদালত বলেছেন, যারা অস্থায়ী বরাদ্দ নিয়ে দখলে রেখেছেন, তারা বৈধ। তবে রায়ের কপি প্রতিবেদকে দেখাতে পারেননি তিনি।
আবু শাহাদাত লাবলু আরও দাবি করেন, মেয়রের সাথে দেখা করার জন্য মাসের পর মাস চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেয়র দেখা করেননি। এর আগে করা আবেদনে স্থায়ী বরাদ্দ চাইলেও সিটি করপোরেশন দেয়নি বলেও জানান তিনি।
ডিএইচডি/জেএম/আইএইচ

