বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বিক্রেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ, হাত ‘গোটাচ্ছেন’ গ্রাহক

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০১ নভেম্বর ২০২২, ০৮:২৪ এএম

শেয়ার করুন:

বিক্রেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ, হাত ‘গোটাচ্ছেন’ গ্রাহক

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় কয়েকমাস আগে চালু হওয়া ‘রয়েল ইন’ নামের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট শুরুর দিকে বেশ জমজমাট ছিল। সন্ধ্যার পর মানুষের আনাগোনা ছিল অনেক। কিন্তু কিছুদিন ধরে এখানকার চিত্র ভিন্ন। সোমবার (৩১ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর ঢুকে দেখা যায় শুনসান নীরবতা। একজন কাস্টমারও নেই রেস্টুরেন্টটিতে।

প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বরত দুজন কর্মী জানালেন, এমন অবস্থা প্রায়ই দিনেরই। আগের মতো পার্টি বা পারিবারিক আয়োজন নেই। অল্প কিছু কাস্টমার আসেন। কিন্তু আগের মতো বিলও হয় না।


বিজ্ঞাপন


একদিকে অর্থনৈতিক মন্দাভাব, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। দুইয়ে মিলে মানুষ অনেকটা দিশেহারা। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছেন। ফলে যে যার মতো করে ব্যয় সংকোচন করে চলার চেষ্টা করছেন। অনেকে বিলাসিতা ছেড়ে সাধারণ জীবন যাপনেও অভ্যস্ত হচ্ছেন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া খরচের তালিকাও কাঁটছাট করছেন কেউ কেউ। এমন অবস্থায় বাইরে কেনাকাটাও অনেকে কমিয়ে দিয়েছেন। নিয়মিত রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করা ভোজন রসিকরাও কিছুটা লাগাম টেনেছেন।

একাধিক নামিদামি রেস্টুরেন্ট, শপিংমলের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নাগরিকদের এমন কাঁটছাঁট করে জীবন চালানোর সত্যতা মিলেছে। আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিজেদের ব্যয় সংকোচনের পদ্ধতির কথা অকপটে জানিয়ে দিচ্ছেন।

dm

মাহমুদুল হাসান নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে নানামুখী সমস্যার তৈরি হয়েছে। অনেক খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছি। যেমন ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে বাইরে বের হলেও এখন দুই সপ্তাহ পর হয়তো বের হচ্ছি। বেশি দূর ঘুরতে যেতে চাইলেও অল্প খরচে বাসায় ফিরতেছি। মোটকথা চাহিদা থাকলেও বেতন না বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: অর্থনীতিবিদদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ!

যদিও সরকারের পক্ষ থেকেই বারবার বলা হচ্ছে, বেশ কিছু পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়াচ্ছেন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। নির্ধারিত দামেও বিক্রি হয় না তেল, চালসহ নিত্যপণ্য। এসবের বিরুদ্ধে অবশ্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারের একাধিক সংস্থা অভিযান পরিচালনা করলেও এর খুব বেশি প্রভাব পড়ে না বাজারে। তাই বাজারের প্রতি মনিটরিং জোরদারের পরামর্শ ভোক্তাদের।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম. সফিকুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জেল-জরিমানা করে সবকিছু ঠিক করা আসলে সম্ভব না। তাই ব্যবসায়ীদের মানবিক হতে হবে। অতি মুনাফার চিন্তা বাদ দিতে হবে।’

একদিকে বাড়তি খরচ, অন্যদিকে গ্রাহক খরা

একাধিক খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে উঠতে যুদ্ধের কারণে তারা চাপে পড়েছেন। এখন শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি নতুন করে বিপদ বাড়িয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে দিনদিন খরচ বাড়ছে।

রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের পোশাকের দোকান ‘মেঘ’ এর কর্ণধার জাহিদা হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এক কথায় বললে বলব আমরা ভালো নেই। আমাদের মার্কেটের সাড়ে তিনশোর বেশি ব্যবসায়ীর অবস্থা একই রকম।’

তিনি বলেন, ‘করোনার বিপদ কাটিয়ে উঠতে উঠতে যুদ্ধ। এখন অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। জিনিসপত্রে দামও বেশি। লোডশেডিংয়ের জন্য জেনারেটর চালাচ্ছি। এতে উৎপাদন কমেছে কারখানায়। কিন্তু দাম কমানো যাচ্ছে না। আবার মানুষের পকেটে টাকা না থাকায় আগের মতো কিনতেও পারছে না।’

dm

মিরপুরে পাঞ্জাবির কারখানা পরিচালনা করেন আবুল হাসান টিটো। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর থেকে কারখানার উৎপাদন অর্ধেক হচ্ছে। দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলেও কারিগরদের বেতন ঠিকই দিতে হচ্ছে। এমন চললে ব্যবসা টেকানো যাবে না।’ 
তবে ফ্যাশন হাউজ ‘অঞ্জনস’র কর্ণধার শাহীন আহমেদ বর্তমানে কাস্টমার কম হলেও পূজায় ভালো বিক্রির কথা জানালেন।

আরও পড়ুন: যুব উন্নয়নে ‘হরিলুট’, হদিস নেই বেকারদের আড়াই কোটি টাকার

ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সবসময়ই বিক্রি কম হয়। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বোঝা যাবে জানুয়ারির দিকে। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় বিক্রি কম। আবার কারখানা-শো রুমে বিদ্যুৎ সংকটে খরচও বেড়েছে।’

অবশ্য এত গেল পোশাক ব্যবসায়ীদের কথা। রাজধানীর বাংলামোটরের ‘দ্যা গ্রীণ লাউঞ্জ’ রেস্টুরেন্টে কথা বলে জানা যায়, চালুর পর থেকেই অনেকটা ঝাঁকঝমকপূর্ণ ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত ভোজন রসিকদের ভিড় থাকত। কিন্তু এখন অনেকটা চাপ কম।

dm

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখানকার একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আনুমানিক ৫ থেকে ১০ ভাগ নিট কাস্টমার কমেছে। আবার যারা আসছেন তারাও আগের মতো খাচ্ছেন না। যার ২ হাজার টাকা বিল হত সে হয়তো এক হাজার, ১২শ টাকার খাবার খাচ্ছে।’

এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারের দামও বাড়ানো হয়েছে। কেউ আবার দাম না বাড়িয়ে পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন।

রাজধানীতে ‘স্টার কাবাবের’ সাতটি শাখা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শাখায় বিক্রি অনেক কমেছে।

আরও পড়ুন: অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়ার শঙ্কা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখানকার একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের এমনও শাখা আছে যেখানে দিনে ৫ লাখ টাকা বিক্রি হত, এখন সেখানে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আগের মতো পার্টিও নেই। তবে দুই একটি শাখায় বিক্রিতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।’

এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার জন্য বাজার মনিটরিং বাড়ানোর প্রতি জোর দিলেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি পুনর্নির্বাচিত হলেন গোলাম রহমান। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, কিন্তু লাগামহীনভবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তাই বাজারে নজর দিতে হবে। অন্যথায় মানুষ আরও কষ্ট পাবে।’

বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর