হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ, গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায়। ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সেই শুরু করেন কবিরাজি। বাবা কবিরাজি পেশায় থাকায় বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল শিখে এই পেশার মাধ্যমে তিনি নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ উপার্জন করতেন। মূলত নারীরাই ছিল মূল টার্গেট।
বাগেরহাটের মনু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হেমায়েত সাজা থেকে বাঁচতে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে পলাতক ছিলেন। তবে র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বিজ্ঞাপন
এ নিয়ে বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এর আগে বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ১২৯টি আংটি, ৩টি শঙ্খ, একটি চেরাগ, দুটি ক্রেস্ট ছাড়াও ১৫টি কবিরাজি সংক্রান্ত বই ও একটি পিতলের পাঞ্জাসহ কবিরাজি সংক্রান্ত অন্যান্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ২০০৩ সালে হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ স্ত্রী-সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজি ব্যবসা শুরু করেন। তার এই পেশায় অন্যতম সহযোগী ছিল মনু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি সোবহান। ২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান ভিকটিম মনুর মাথা ব্যথার রোগকে মানসিক রোগ বলে আখ্যা দিয়ে তাকে কবিরাজি চিকিৎসার জন্য হেমায়েতের কাছে নিয়ে আসে। মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য তার কাছে টাকা পাঠাতেন। সেখান থেকে জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করতেন মনু পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে কাপড়ের ব্যবসা আর স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনুর কাছে লাখের বেশি টাকা জমা হয়। এই অর্থের বিষয়টি জানতে পেরে হেমায়েত সেই টাকা আত্মসাতের ফন্দি আঁটে।
পরে মাথা ব্যথার চিকিৎসার নামে মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যম নিয়মিত ঘুমের ওষুধ দেওয়া শুরু করেন হেমায়েত। সেই সঙ্গে মনুকে শত্রু পক্ষের জ্বিনের আক্রমণের ভয় দেখিয়ে তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্রসহ টাকা-পয়সা নিরাপত্তার জন্য হেমায়েতের পীরের কাছে জমা রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে মনুর প্রচণ্ড ঘুম ও মাথা ব্যথার প্রবণতা কিছুটা কমে আসলে হেমায়েতের ওপর আস্থা তৈরি হলে সে তার টাকা-পয়সা ও দলিলপত্র সরল বিশ্বাসে হেমায়েতের কাছে জমা দেয়।
বিজ্ঞাপন
পরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হেমায়েত সহযোগীসহ তাকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে মনুর জ্ঞান ফিরে আসলে তিনি পুলিশের নিকট গিয়ে অভিযোগ করার যেতে চান। ওই সময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সহযোগী সোবহানকে নিয়ে হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে জখম করে। পরে গলাকেটে মনুর মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা লাশ বস্তাবন্দি করে হেমায়েতের বাড়ির সামনের খালের বিপরীত পাশের ধানক্ষেতে ফেলে দেয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ২০০৫ সালে বাগেরহাটের মনুকে হত্যার পর ঢাকায় এসে মিরপুরের মাজারে আশ্রয় নেন হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ। পরে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে আজমীর শরীফ মাজারে চলে যান। কবিরাজি পেশাসহ বিভিন্ন ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সেখানে তিন বছর অবস্থান করে ২০০৮ সালে পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। এরপর ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি নিজের আসল পরিচয় গোপন করার জন্য লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে জাহিদুল ইসলাম নামে নতুন একটি এনআইডি কার্ড তৈরি করেন।
এভাবে প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিয়ে করেছেন হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজ। সেই সঙ্গে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের নামে তাবিজ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ সমাধানের কথা বলে মোট অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাজ চালিয়ে যান।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, মনুকে হত্যার করে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকার পর মিরপুরে তিন বছর অবস্থানকালীন নিজের প্রতারণার বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হলে হেমায়েত ঠিকানা পরিবর্তন করেন। এরমধ্যে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং সর্বশেষে গত ৫ বছর ধরে মোহাম্মদপুর বসিলার বিভিন্ন স্থানে ছিলেন তিনি। তবে বসিলায়ও একইভাবে তিনি কবিরাজি ব্যবসা করতে থাকেন। তাবিজ প্রদানের পাশাপাশি নিজের বশ করা ‘জ্বিনের বাদশার’ কথা বলে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের নামে অর্থ আত্মসাতের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, ২০১২ সালে দারুস সালাম থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে হেমায়েতের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। এছাড়াও ২০১৭ সালে সে তার কবিরাজি কাজে ব্যবহৃত কষ্টি পাথরের মূর্তি রাখার দায়ে চোরাকারবারি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে দেড় মাস হাজতবাসও করেছেন। মূলত হত্যা ও প্রতারণার সাজা থেকে বাঁচতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দিতে বারবার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করত হেমায়েত। এ জন্য মাঝে-মাঝেই সে তার চুল-দাড়ির রং পরিবর্তন ছাড়াও বেশভূষা বদল করতেন। গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া চলছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে র্যাব।
এমআইকে/আইএইচ

