বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রথম আইজিপির সেই চেয়ারও এখন স্মৃতির অংশ

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

প্রথম আইজিপির সেই চেয়ারও এখন স্মৃতির অংশ

একটি চেয়ার এখন স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে। চার পায়াবিশিষ্ট গোলাকার চেয়ারটির মধ্যখানে বেতের কাজ রয়েছে। চেয়ারটি একসময় ব্যবহার করতেন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি মরহুম আবদুল খালেক। ৫০ বছর আগের সেই চেয়ার বর্তমান সময়ের পুলিশ সদস্যসহ নতুন প্রজন্ম সবাই দেখতে পারছেন। কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছেন সেই সময়ের স্মৃতিতেও।

চেয়ারটি বর্তমানে সংরক্ষণ আছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। শুধু তাই নয়, পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে দেশে প্রথম আইজিপি লিখেছিলেন একটি মর্মস্পর্শী চিঠি, সেটিও রয়েছে সংরক্ষিত। কালের পরিক্রমায় এখনও যুদ্ধ স্মৃতির অংশ হিসেবে সাক্ষী দিচ্ছে সেই চিঠি।


বিজ্ঞাপন


১৯৭১ সাল উত্তাল সারাদেশ। শৃঙ্খল ভেঙে একটি স্বাধীন দেশের জন্য মুক্তির নেশায় বাঙালিরা। সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের সাধারণ মানুষের ভূমিকা যেমন ছিল তেমনি বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরাও পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার যার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল।

পুলিশ সদর দফতর থেকে জানা গেছে, মুজিবনগর সরকারের সেই সময় থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি হিসেবে ২৩ এপ্রিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন আবদুল খালেক। এছাড়াও তিনি ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৩ সালের ১০ জুন তিনি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তবে আবদুল খালেক মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ২০১৯ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের একাধিক কর্মকর্তা এই পাওয়ায় বেশ গর্ববোধও করেন। বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি নেই, তবে তার ব্যবহৃত সেই চেয়ারটি সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। তাইতো জাদুঘরে স্থান পাওয়ায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা স্বচক্ষে দেখে যাচ্ছেন প্রায় ৫০ বছর আগের সেই চেয়ার।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ও পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা স্যারকে নিয়ে গর্ব করি। স্যার নেই তাঁর ব্যবহৃত চেয়ারটি আমরা এই জাদুঘরে রাখতে পেরেছি। চেয়ারটি এত আগের, দর্শনার্থীরা দেখে অবাক হচ্ছেন। এই জাদুঘরে পুলিশদের যুদ্ধের নানা স্মৃতিও রয়েছে। বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ধারণা দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ইতিহাস তুলে ধরা এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন তুলে ধরাই আমাদের লক্ষ্য। এখানে মুক্তিযুদ্ধের বইও আছে, লাইব্রেরিও আছে।


বিজ্ঞাপন


পুলিশ সদর দফতর এবং পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি আবদুল খালেকের জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানাধীন জিরুইন গ্রাম। ১৯২৭ সালের ১ মার্চ জন্ম নেওয়া আবদুল খালেক দেবিদ্বার গঙ্গামন্ডল রাজ ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি শাস্ত্রে সম্মানসহ ১৯৫০ সালে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পরে তৎকালীন সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান (সিএসপি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫১ সালে যোগ দেন পুলিশ ক্যাডারে।

Policeতৎকালীন গোপালগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ মহকুমায় এসডিপিও এবং বরিশাল, পাবনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবদুল খালেক। পুলিশ একাডেমী সারদায় তিনি প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুজিবনগর সরকারের সময় থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইজিপি হিসেবে ২৩ এপ্রিল, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন বলেও জানা যায়। এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পুলিশ একাডেমী সারদায় কর্মরত থাকাকালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি একটি মর্মস্পর্শী চিঠিও লিখেছিলেন।

বর্তমান সময়ে এসে সেই সময়ের নানা স্মৃতি দেখতে পারা নিয়ে কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা হলে ঢাকা মেইলকে তারা জানান, জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা বিষয়ে অনেক তথ্যই জানা যায়। দর্শনার্থী হোসাইন বলেন, আমি এখানে কিছু ইউনিক সংগ্রহ দেখেছি। ভালো লেগেছে, ইতিহাসটাও জানলাম। দেখলাম, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্যবহৃত পিস্তল। এছাড়াও আমাদের প্রথম আইজিপি ব্যবহৃত চেয়ার।

শাকিলের আরেক বন্ধু সাজ্জাতুর রহমান হাসান বলেন, যে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রথম পাক বাহিনীর আক্রমণের খবর দেওয়া হয় সেটি দেখলাম। পুলিশের আগের পোশাকের বিবর্তন দেখলাম। ৫০ বছর আগের সেই সময়ে একজন আইজিপি কি ধরনের চেয়ার ব্যবহার করতেন তাও দেখলাম। অনেক কিছু শিখলামও। একটি সুন্দর দেশ গড়তে কতকিছু করেছেন আমাদের পূর্ব প্রজন্ম!

বিষয়টি নিয়ে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত এসপি মো. এনায়েত করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এই জাদুঘরে অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। আমাদের ইউনিক সংগ্রহ আছে। প্রথম আইজিপি স্যারের চেয়ারটি একটি স্মৃতিচিহ্ন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ যেভাবে প্রতিরোধ করেছে তার একটি দৃশ্যও ফুটে উঠে এই জাদুঘরের সংগ্রহ করা জিনিসগুলোর মাধ্যমে। আগত দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হয়ে দেখেন, ইতিহাস জানেন। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম শিক্ষার্থীরা আসলে অনেক সময় নিয়ে জাদুঘরটি ঘুরে দেখেন। এখানে থাকা সংগ্রহগুলো ভালোভাবে দেখেন এবং এর পেছনের ইতিহাসও জানতে পারেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রায় হাজারখানেক বই রয়েছে লাইব্রেরিতে। অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যায়। এছাড়া জাদুঘরে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, টুপি, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম লেটারসহ শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস জানতে জাদুঘরটি ভূমিকা রাখছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

ডব্লিউএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর