শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

তীব্র গ্যাস সংকট: সমাধান কোন পথে?

তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৪:৪৮ এএম

শেয়ার করুন:

তীব্র গ্যাস সংকট: সমাধান কোন পথে?

আবাসিক ও শিল্পখাতে রাজধানীসহ সারাদেশেই তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আবাসিক এলাকায় প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে শুরু করে দুপুর ৩টা পর্যন্ত গ্যাস পাচ্ছেন না অধিকাংশ এলাকার মানুষ। তবে ৩টার পর গ্যাস এলেও তা একেবারেই সীমিত। আগে সাধারণত শীতকালে এবং নির্দিষ্ট এলাকায় গ্যাস সংকট বেশি থাকত। কিন্তু এখন সব এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে অনেক শিল্প কারখানায় শিফট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের বেশকিছু অঞ্চলের শিল্প-কারখানা গত কয়েক মাসে দফায় দফায় গ্যাস সংকট মোকাবিলা করেছে। সম্প্রতি কয়েকটি স্থানে আবারো দেখা দিয়েছে গ্যাসের চাপ সংকট। যার কারণে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বয়লার, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক উৎপাদন। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার টেক্সটাইল মিল, সিরামিক কারখানাসহ অন্য শিল্পগুলোও এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। বড় বড় স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং-প্রিন্টিং বা সিরামিকের মতো কারখানাগুলোয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। মূলত ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে এসব কাজ চলে। আর এ পাওয়ার জেনারেশনের মুখ্য জ্বালানি হলো গ্যাস। কোনো কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে গেলে বা গ্যাসের চাপ কমে গেলে তার প্রভাব পড়ে গোটা উৎপাদন প্রক্রিয়ায়।


বিজ্ঞাপন


সূত্রমতে দেশে দিনে মোট ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা। এর বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। কারণ, চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কয়েক মাস ধরে কেনা বন্ধ আছে। অন্য সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অথবা সার কারখানায় সরবরাহ কমিয়ে শিল্পে গ্যাসের চাহিদা পূরণ করা হতো। এখন সেই সুযোগটিও নেই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প জ্বালানি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। ফলে গ্যাস দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। সার কারখানা বন্ধ করে দিলেও বিপদ। বিশ্ববাজারে সারের দাম চড়া, আমদানিতে বাড়তি খরচ লাগছে। তাই দেশি সার কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।

এছাড়াও পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এখন দিনে ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে পাচ্ছে ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে তারা গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় গ্যাস দিতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাজধানী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরে গ্যাস সরবরাহ করছে তিতাস। এরমধ্যে আবাসিক গ্রাহক রয়েছে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৮ জন। পাশাপাশি বাণিজ্যিক গ্রাহক সংখ্যা ১২ হাজার ৭৫, সিএনজি ৩৯৬, ক্যাপটিভ পাওয়ার এক হাজার ৭০১টি। এছাড়া শিল্পগ্রাহক রয়েছে পাঁচ হাজার ৩১৩টি। এছাড়াও তিনটি সার কারখানা ও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই কোম্পানিটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগী হতে হবে। তা না হলে এর কোনো সমাধান হবে না। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চলমান যে জ্বালানি সংকট এটা তো সরকারের মহাপরিকল্পনার ফল। সরকার মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল যে, আমদানি করবে। আমদানিভিত্তিক তারপর কয়লা পরমাণুভিত্তিক। অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রকল্প সরকারের মহাপরিকল্পনায় ছিল। সরকার গ্যাস অনুসন্ধান না করে এলএনজি আমদানি করছে। কয়লা পারমাণবিকের ওপরে গুরুত্ব দিয়েছে। নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান না করার ফলে এলএনজি আমদানি যে করতে হয়েছে, এটার তো দাম অনেক বেড়ে গেছে। তেলের দামও বেড়ে গেছে। সেগুলো সমস্যা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো সমস্যাই থাকত না যদি গ্যাস অনুসন্ধান করত ঠিকমতো। আর আমরা তো প্রায় ২০ বছর ধরে বলছি যে, জাতীয় সংস্থাকে শক্তিশালী করা হোক। এই পন্থায় নিজেদের সক্ষমতার ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান করা হোক। নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা বা উৎপাদন বাড়ানো হোক। তবেই সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠবে।’


বিজ্ঞাপন


কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই সরকারকে বলে আসছি জ্বালানিতে আমদানি নির্ভর না হয়ে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে। কিন্তু সরকার নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা সাশ্রয়ী মূল্যে উত্তোলন ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সংকট হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।’

এদিকে সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে গ্যাস আমদানির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এক সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা এ বছর ও আগামী বছর স্বল্পমেয়াদী চুক্তির আওতায় প্রাকৃতিক গ্যাস আনতে দ্বিপক্ষীয় ও ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করছি। বর্তমানে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করছে- চুক্তিটি ২০২৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।’

সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে গ্যাস অথবা জ্বালানি আমদানি করবে- যা মূল্য সমঝোতার ওপর নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা কমমূল্যের সুনির্দিষ্ট  প্রস্তাব পাই, তবে গ্যাস বা জ্বালানি আমদানি করব। সরকার পিএসসি (প্রোডাকশন শেয়ার কন্ট্রাক্ট) পর্যালোচনার করে চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ দরপত্র আহ্বানের চেষ্টা করছে।’

তিনি বলেন, ‘দু’বার  দুটি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্যতা না থাকায় তারা পিছিয়ে গেছে। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান চালাতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। তবে আমরা দরপত্রের মাধ্যমে এই অনুসন্ধান কাজ করব।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ছে। তাই আমাদের গভীর সমুদ্রের পাশাপাশি, উপকূলেও অনুসন্ধান কাজ জোরদার করতে হবে।’

টিএই/এমএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর