বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

প্রীতিলতার ব্যবহৃত অস্ত্র দেখতে পারছে এই প্রজন্ম

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৫৯ এএম

শেয়ার করুন:

প্রীতিলতার ব্যবহৃত অস্ত্র দেখতে পারছে এই প্রজন্ম
ছবি: ঢাকা মেইল

বাঙালি চেতনায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের একটি নাম ‘প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার’। ১৯১১ সালের ৫ মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন তার পিতা এবং মাতা প্রতিভাদেবী। তাদের ছয় সন্তানের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ কন্যা।

চলতি মাসে (২৪ সেপ্টেম্বর) বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৯০তম আত্মাহুতি দিবস ছিল। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণকালে শহীদ হন মাস্টারদা সূর্যসেনের এই বীর সহযোদ্ধা। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণকালে প্রায় শতবছর আগে ব্যবহৃত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের অস্ত্র (দশমিক ৩৮ বোরের রিভলবার) এখন দেখার সুযোগ পাচ্ছে এই প্রজন্ম। যেটি দেখতে হলে যেতে হবে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। রাজধানীর রাজারবাগ অবস্থিত এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে প্রায় শত বছর আগের সেই অস্ত্রটি।


বিজ্ঞাপন


ব্রিটিশ পুলিশের হাত হয়ে এটি এখন বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। কাচঘেরা শেলফে রাখা একটি দশমিক ৩৮ বোরের রিভলবার। পাশে লেখা রয়েছে-প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহৃত অস্ত্র। অনেক দর্শনার্থী ঘুরতে এসে এই দুর্লভ অস্ত্র দেখে অবাক হয়ে যান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী কন্যার ভূমিকা কল্পনায় চিন্তা করেন অনেক দর্শনার্থীরা। এমন দুর্লভ জিনিস দেখার সুযোগ করে দেওয়ার ধন্যবাদও জানিয়েছেন একাধিক দর্শনার্থীরা।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ও পুলিশ মুক্তযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, পুলিশ মুক্তযুদ্ধ জাদুঘরে আপনি অনেক  দুর্লভ জিনিস দেখতে পায়। এখানে বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ধারণা দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ইতিহাস তুলে ধরতেই অনেক কিছু আছে। এখানে একটি লাইব্রেরি আছে যেখানে দুই হাজারের বেশি এখানে বই রয়েছে।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মকর্তা অতিরিক্ত এসপি মো. এনায়েত করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের এই জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন আছে। আমাদের ইউনিক জিনিস আছে। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহৃত পিস্তল আমাদের ইউনিক সংগ্রহ। বর্তমান প্রজন্ম যারা এধরনের সংগ্রহ দেখছেন তারা জানতে পারছেন সে সময়ের প্রেক্ষাপট।

Pritilata


বিজ্ঞাপন


শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখছিলেন প্রীতিলতা, তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সক্রিয় হয়ে উঠছিলেন। প্রীতিলতার আত্মাহুতি বিষয়ে ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে বিপ্লবীরা আক্রমণ করতে গিয়েছিল, কিন্তু পারেনি। কারণ, সেদিন ছিল গুড ফ্রাইডে। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড়ে ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা, ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ওই ক্লাবের ধারে-কাছে যেতে পারত না। সেখানে লেখা ছিল, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।’

সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা হাল ছাড়েননি, বরং নতুনভাবে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। ১৯৩২-এর ১০ আগস্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন আবারও ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে পুনরায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতীজ্ঞা ছিল, ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থেকেও থাকে, তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। প্রতিজ্ঞানুযায়ী তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্র সৈকতে তার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।

এরপর মাস্টারদা ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফের ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এই আক্রমণের দায়িত্ব এবার তিনি নারী বিপ্লবীদের দেবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ে গেলেন। এবার আক্রমণের নেতৃত্বের ভার নিতে চাইল একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা। সদস্য সংখ্যা হলো ১৫ জন। ২৩ সেপ্টেম্বরের সে আক্রমণে দিন প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধূতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেওয়ার জন্যে মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভেতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫-এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।

police

প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘনঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠেছিল। যেন পাহাড়তলীতে কেঁপে উঠেছিল খোদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু সহযোদ্ধাদের সাথে আক্রমণ চালিয়ে যান। এরপর প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে দলের সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। কিন্তু আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন এবং যারা আহত হয়নি সেসব বিপ্লবীদের দ্রুত স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেন। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিপ্লবীরা সবাই স্থান ত্যাগ করেন। প্রীতিলতার মৃত্যুর দিনটি ছিল ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে মাত্র ২১ বছর ৪ মাস ১৯ দিন বয়সে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন তিনি। 
 
সেই পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবটি বর্তমানে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা জাদুঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে যেখানে প্রীতিলতা আত্মহুতি দিয়েছিলেন, সেখানে  ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা ভাস্কর্য’ উন্মোচন করা হয়। প্রীতিলতার এই আবক্ষমূর্তি কলকাতার ভাস্কর গৌতম পাল তাম্র দিয়ে তৈরি করেন। এছাড়াও ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রীতিলতার জন্মস্থান পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স। সুদৃশ্য কমপ্লেক্সের সামনেও রয়েছে বীরকন্যা প্রীতিলতার আবক্ষ ভাস্কর্য। জাদুঘরে স্থান পাওয়ায় বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহৃত অস্ত্রও এখন দেখার সুযোগ মিলছে সবার। 

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ঘুরতে আসা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর আনজুম আরা বলেন, আমরা চারজন এসে দেখলাম। এখানে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি চিহ্ন আছে। সেই সময়ে আমাদের পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা এসবের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে।

jadugar

রাজধানীর একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সাহিদুল সিয়ামকে নিয়ে বাবা মা দুজনেই ঘুরে দেখেন এই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে গিয়ে বাবা সাজ্জাদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, সন্তানকে জাদুঘর দেখালাম ও বার বার নানান প্রশ্ন করছে এটি কি? ওটা কি? ছোট মানুষ অনেক প্রশ্ন মনে। আমারও ভালো লেগেছে এখানে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্যবহৃত অস্ত্র দেখে নিজেই চমকে গেছি। পত্রিকা বইতে যে নামটি দেখেছি তার ব্যবহার করা কিছু দেখলাম। না আসলে এটা জানতেই পারতাম না। এই ধরনের জাদুঘরে আসলে আসলে ইউনিক কিছু দেখ যায় বলেন তিনি।
 
জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে দেখেন সংগ্রহে থাকা স্মৃতি চিহ্নগুলো। পুলিশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বা পরবর্তীতে ব্যবহৃত জিনিসগুলো রয়েছে এখানে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন কোনটি কি বা কি কাজে ব্যবহার হয়। সন্তানরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে দেখা যায়। এছাড়াও অনেক শিক্ষার্থীরা একত্রে এসে নিজেদের মধ্যে এসব যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত ওয়্যারলেস সেট, পাগলা ঘণ্টা, যুদ্ধ স্মৃতির বেঞ্চ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আহত দুই পুলিশ সদস্যকে মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁদের দুজনকে দুটি বেঞ্চের ওপর রেখেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় সেটিও এখন স্মৃতি হিসেবে আছে জাদুঘরে। তবে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্যবহৃত অস্ত্রে সামনে এসে সকল আলোচনা তখন সেই ব্রিটিশ বিরোধী কন্যাকে নিয়েই করেন আগত দর্শনার্থীরা। 
 
 ডব্লিউএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর