বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে অর্ধশত যুবককে পাচার করে চক্রটি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে অর্ধশত যুবককে পাচার করে চক্রটি

তোফায়েল আহমেদ। কোনোমতে এসএসসির গণ্ডি পেরোন। দীর্ঘদিনের বেকার জীবন দূর করতে চলে যান দুবাইয়ে। সেখানে টানা ২৪ বছর বাবার হোটেলে কাজ করে করোনাকালে ফিরে আসেন দেশে। আয়-রোজগার না থাকায় জড়িয়ে পড়েন মানবপাচারে। খুলে বসেন এজেন্সি ব্যবসা। যদিও সেটির কোনো লাইসেন্স ছিল না। এভাবে স্বল্প সময়েই উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক বেকার যুবককে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ পাঠাতেন। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা একজনের মাধ্যমে তাদেরকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করতেন। এভাবে প্রায় অর্ধশতাধিক যুবককে ফাঁদে ফেলে পাচার করে চক্রটি।

রোববার বিকেলে চক্রটির চার সদস্য কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও গুলশান থেকে গ্রেফতার হয়। তারা হলেন- তোফায়েল আহমেদ (২৮), আক্তার হোসেন (৩৮), আনিছুর রহমান(৩৬) ও রাসেল (৩০)। তাদের সবার বাড়ি কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। গ্রেফতারের সময় ১৬টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক বই, ৪টি স্ট্যাম্প, ৫টি মোবাইল ফোন, ৪টি বিএমইটি কার্ড ও ৪টি রেজিস্ট্রার উদ্ধার করা হয়।


বিজ্ঞাপন


গ্রেফতারদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে সোমবার সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। সেখানে কথা বলেন র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. ক. আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি জানান, চক্রটি বিভিন্ন বেকার যুবকদের টার্গেট করতো। তারা বলতো বিদেশে গেলে তেমন টাকা খরচ হবে না। এই বলে তারা তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আদায় করতো। আবার ইউরোপ যাওয়ার কেউ ইচ্ছা পোষণ করলে তার কাছ থেকে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা নেওয়া হতো।

rab-2তিনি আরও জানান, চক্রটির হোতা তোফায়েল। সেই মূলত বাংলদেশে এজেন্সি খুলে মানবপাচারের কাজটি করতো। আর দুবাইয়ে জাহিদ নামে এক ব্যক্তি ছিল তার সহযোগী।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দুবাইয়ে দীর্ঘদিন থাকার পর দেশে ফিরে বেকার হয়ে পড়েন তোফায়েল। সেই সময়ে উপার্জন না থাকায় তিনি তার পরিচিত দুবাই প্রবাসী জাহিদের মাধ্যমে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন। তিনি তার নিজ বাড়ি চৌদ্দগ্রামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করেন। কিন্তু সেই এজেন্সির কোনো লাইসেন্স ছিল না। তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে যাতায়াত করার ফলে নিজেদের প্রয়োজনে তাদের বিভিন্ন ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় ছিল। এছাড়াও দুবাই প্রবাসী জাহিদ দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। জাহিদের মাধ্যমে তোফায়েল, আনিছুর এবং আক্তারের পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমেই রাসেলসহ অন্যান্য দালালদের সঙ্গে তোফায়েলের পরিচয় হয়। জাহিদ দুবাই থেকে ভ্রমণ ভিসা তৈরিতে চক্রটিকে সহায়তা করত।


বিজ্ঞাপন


তোফায়েল নিয়মিত দুবাই আসা যাওয়া করতো। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে দুবাই গিয়ে সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসেন বলে র‌্যাব জানতে পেরেছে।

প্রতারণার টাকায় অভিজাত অফিস

গ্রেফতার আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক পাস করেন। কিছুদিন বনানী এলাকায় একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পরে স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। আনিছুর এবং আক্তার একই এলাকার হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রথমে তারা পৃথকভাবে মানবপাচারে জড়িত থাকলেও গত বছরের ডিসেম্বরে থেকে তারা সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যেই গুলশানের একটি অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া করেন। পরে সেটি সুসজ্জিত করে অফিস চালু করা হয়। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় দালাল নিযুক্ত করেন। বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে তারা। এজেন্সেটির চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর আনিছুর রহমান।

স্কুল শিক্ষক থেকে মানবপাচারকারী

আনিছুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান পাস করেন। কিছুদিন রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করেন। কিন্তু স্বল্প শ্রমে তার সংসার চলতো না। ফলে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন এবং এটিকে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন। তার মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে প্রবাসী বন্ধু রয়েছে। তাদের মাধ্যমে তিনি ভুয়া ডিমান্ড লেটার, ইনভাইটেশন ও ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করতেন। পরে সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন দেশে যুবকদের পাঠিয়ে মানবপাচার করতেন। এছাড়াও এসব প্রবাসী দালালরা ভুক্তভোগী ও অভিভাবকদের বিদেশ থেকে ফোন দিয়ে উত্তম জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতারণায় সহায়তা করতেন।

rab-3

রাসেল কুমিল্লার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাস করেছেন। দুই বছর ধরে তিনি এই চক্রের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। আক্তার এবং আনিছুর তার বিশ্বস্থতার জন্য সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করে। এছাড়াও দুবাই প্রবাসী জাহিদের তিনি গৃহশিক্ষক ছিলেন। জাহিদ এবং রাসেলের নিজ বাড়ি কুমিল্লা এলাকায় হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্যতা রয়েছে। 

র‌্যাব জানিয়েছে, এই চক্র গত দুই বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শতাধিক মানবপাচার করেছে। তারা সকলেই বিদেশে গিয়ে কাজ না পেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকারসহ আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরে এসেছে এবং অনেকেই এখনো বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মানবপাচার করে অর্থ উপার্জন করাই চক্রটির সদস্যদের একমাত্র পেশা। মানবপাচার থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করত।

এছাড়াও অভিজাত এলাকায় উচ্চ ভাড়ায় সুসজ্জিত অফিস পরিচালনা করতো। এই চক্রের অপরাপর সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্ঠা অব্যাহত আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। 

এমআইকে/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর