শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বিনা টিকেটে যাত্রী তুলছে, চলছে খেয়াল খুশিতে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

বিনা টিকেটে যাত্রী তুলছে, চলছে খেয়াল খুশিতে

আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও দেখা নেই বাসচালকের। গাড়িতে ২০ থেকে ২৫ জন যাত্রী। কেউ স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী, আবার কেউ চাকরিজীবী। এদিকে সময় চলছে নিজের গতিতে। ঘড়ির কাটায় তখন বেলা ১২টা। বিরক্ত হচ্ছেন যাত্রীরা। চিৎকার শুরু করলেন অনেকে। টিকিট কাউন্টার থেকে জানানো হলো— চালক টয়লেটে গিয়েছেন। তিনি এলে গাড়ি ছাড়বেন। অবশেষে তিনি এলেন। পাশের দোকান থেকে সিগারেট কিনলেন। সিগারেটে আগুন দিয়ে দু-এক টান দিলেন। বাস ছেড়েছেন। তখন সময় ১২টা ৩৭ মিনিট। কিছু দূর যেতে গাড়িতে উঠতে ইশারা করলেন এক যাত্রী। ওমনিই তাকে তুলতে গাড়ি থামালেন ড্রাইভার মহাশয়। বিনিময়ে পকেটে ভরলেন ১০ টাকার একটি নোট। ঢাকা নগর পরিবহনের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে আক্ষেপের সুরে ঢাকা মেইলের কাছে কথাগুলো বলছিলেন উর্মি আক্তার। 

রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুরের রাস্তায় দেখা সিটি কলেজের ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে। অকপটে বর্ণনা করলেন ত্যক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তবে শুধু উর্মির নয়, দুঃসহ এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে ঢাকা নগর পরিবহনের অনেক যাত্রীকে। 


বিজ্ঞাপন


এদিকে রাজধানীতে নগরবাসীর মাঝে স্বস্তি ও গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় এই বাস সার্ভিস চালু করা হলেও এর সুফল পাচ্ছেন যাত্রীরা। 

নগর পরিবহনে বিনা টিকেটে ভ্রমণ এবং দেরি করে বাস ছাড়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে দিন দিন পরিবহনটিতে যাত্রী কমছে। আস্থা হারাচ্ছেন নগরবাসী। তার ওপরে বাড়তি পাওনা রয়েছে, কাউন্টারে থাকা কর্মীদের খারাপ ব্যবহার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্ধশত বাস নিয়ে এই সার্ভিস চালু হলেও বাসের সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। যদিও এই বিভাগের সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, যাত্রী বেড়েছে এবং তারা আগামীতে আরও বাস নামানোর পরিকল্পনা করছেন।

প্রতিদিনই এভাবে বিনা টিকেটে যাত্রী তুলে পরিবহনটিকে ক্ষতির মুখে ফেলে দিচ্ছে চালক ও হেলপাররা। এছাড়াও ঘাটারচর কাউন্টার থেকে কাঁচপুর রুটে ছুটে প্রতিটি বাস ছাড়া হচ্ছে চালক, হেলপার ও কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের খেয়াল খুশিমতো। সব সময় বাসগুলো দেরিতে ছাড়ার কারণে জরুরি কাজে বের হওয়া যাত্রীরা টিকেট ফেরত দিয়ে অন্য বাহনে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কারও যেন মাথা ব্যথাই নেই। 


বিজ্ঞাপন


শনিবার সন্ধ্যায় পল্টন মোড় থেকে নগর পরিবহনে ওঠেন কামরুল ইসলাম। তাকে বহনকারী বাসটি কিছুদূর গিয়েই এক যাত্রীকে কাউন্টার ছাড়াই গেট খুলে তুলে নিলো। এরপর আরও কিছুদূর গিয়ে তুলেছে চারজনকে। তারা মতিঝিলে নেমে যাওয়ার সময় চালককে ১০ টাকা করে হাতে ধরিয়ে দেন। কামরুল বলেন, ‘আমরা টিকেট কাটছি কাউন্টার থেকে। তাও আবার অপেক্ষা করে। কিন্তু তারা মাঝপথে ওঠে পড়লো টিকেট ছাড়াই। আর সেই টাকার পুরোটাই চলে গেল চালকের পকেটে। এভাবে চালকরা ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে মাঝপথে পাওয়া টাকাগুলো খেয়ে ফেলছে। বিষযটি দেখার কি কেউ নেই?’

মোহাম্মদপুর কলেজের ছাত্র রবিন বলেন, এত টাকা খরচ করে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বাসটিতে যাত্রী তোলার জন্য কাউন্টার বানানো হলো। কিন্তু প্রতিটি বাসেই বিনা টিকেটে মাঝপথে যাত্রী তোলা হচ্ছে। তাহলে কাউন্টার আর টিকেট সিস্টেম থেকে লাভটা কি? 

সিটি কলেজের যাত্রী উর্মি জানালেন, তিনিসহ তার ১২ বান্ধবী শুরুর দিকে এই বাসে এক সঙ্গে কলেজে আসতেন। কিন্তু কয়েক মাস বাসটির সেবা নিচে নেমে এসেছে। সময় মতো ছাড়ে না, টিকেট কেটে বসে থাকতে হয়, মাঝপথে যাত্রী তোলে। বিশেষ করে টিকেট কেটে বসে থেকে বাস না পাওয়ার কারণে তার বান্ধবীরা এখন সিএনজিতে মোহাম্মদপুর যাতায়াত করেন। তিনিও তাদের মতো করে কলেজে যাবেন আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।  

শুধু উর্মি নন, এই বাসে যাতায়াতকারীরা প্রতিদিনই দেরি বিড়ম্বনায় পড়ছেন। ফলে বেশির সময় তারা জরুরি কাজে বের হলেও গন্তব্যে সময় মতো পৌঁছাতে পারছেন না। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তমালিকা বলেন, ‘আমার মা ও আমি আগে প্রতিদিন এই বাসে যাতায়াত করতাম। কিন্তু এখন এই বাস মানে বিরক্ত। সময় মতো ছাড়ে না, টিকেট কাটলেও বাস আসে না। এজন্য আমরা বিকল্পবাহনে যাতায়াত করি।’

ঘাটারচরে বসবাস করা স্কুল শিক্ষক সাবিনা আক্তার বলেন, ‘চালকরা তাদের খেয়াল-খুশি মতো বাস ছাড়েন। এভাবে তো একটি পরিবহন চলতে পারে না। কোনো জবাবদিহি নেই। কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি মুখ ভেঙ্গিয়ে কথা বলেন। কখন বাস ছাড়বে সেটিও তারা বলতে পারেন না। চালক চা, বিস্কুট, সিগারেট খেয়ে তারপর গাড়িতে ওঠেন। এটা কোনো কথা হলো বলেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগর পরিবহন চালুর পর থেকে প্রায় ২০টির মতো বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু ডাবল ডেকার বিআরটিসির বাসগুলো চলছে। তাতেও যাত্রী মিলছে না। যাত্রী না মেলার কারণ হিসেবে মোহাম্মদপুর কাউন্টারের একজন জানালেন, ‘যাত্রীরা টিকেট কেটে বসে থাকেন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টাও বাস আসে না। এটি হচ্ছে বাস কম থাকার কারণে। শুধু তাই নয়, কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের আচরণও বড্ড খারাপ বলে অভিযোগ এই বাসে যাতাযাতকারী যাত্রীদের।’

গত শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য বসিলা কাউন্টার থেকে বাসে ওঠেন সানজানা আহমেদ। বাসটি মোহাম্মদপুর তিন রাস্তা পার হয়ে থাকা কাউন্টারের কাছে এসে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। ওই সময় বলা হয়, বাসের একটি চাকায় কোনো সমস্যা হয়েছে। তাই সেটি সারাতে সময় লাগবে। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাসটি এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পরে বলা হয়, অন্য আরেকটি বাস আসছে। এভাবে প্রায় সেখানে ৩০ মিনিট যাত্রীদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। শেষে জানা গেল, সেই বাসটিতে বিকল্প চাকা ছিল না। বিষয়টি জানতে পেরে যাত্রীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ওই সময় হেলপারের সঙ্গে এক যাত্রীরা মারামারির পর্যায়ে গেলে যাত্রীরা তাকে শান্ত করেন। এরপর আরেকটি বাস এলে যাত্রীরা সেটিতে ওঠে গন্তব্যে রওনা হন। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক ধ্রুব আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের কাছে এমন সব অভিযোগ এসেছে। আমরা বিষয়গুলো যাচাই করার জন্য খুব শিগগিরই মাঠে নামবো। আমরা যাত্রীদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। বাসের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।

এমআইকে/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর