রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

রাতের আঁধারে সড়কে পুলিশ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ওরা কারা?

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

রাতের আঁধারে সড়কে পুলিশ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ওরা কারা?
ফাইল ছবি

হাতিরঝিল সড়ক হয়ে নিজের মোটরবাইকে চেপে রামপুরার দিকে যাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অনামিকা (ছদ্মনাম)। পথে এসিআই ভবনের সামনে পৌঁছালে তাকে ফলো করা শুরু করে মোটরবাইকে থাকা এক যুবক। এর কিছু সময় পরই মোটরসাইকেল নিয়ে অনামিকার সামনে দাঁড়িয়ে তার গতিরোধ করেন সেই যুবক।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুঠাম দেহের অধিকারী সেই যুবক বাইক থেকে নেমেই অনামিকাকে বলেন- ‘আপনার কাছে অবৈধ কিছু রয়েছে’। সঙ্গে অনামিকার বাইকের চাবিও খুলে নেন। ওই সময় মুঠোফোনটিও কেড়ে নিতে চাইলে অনামিকা বাধা দেন। তবে পরিস্থিতি অনুকূলের বাইরে যাচ্ছে দেখে রাস্তায় ছুটে চলা বেশ কয়েকটি গাড়ি হাতের ইশারায় থামানোর চেষ্টা করেন অনামিকা। সেই সঙ্গে সহায়তার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। এতে আশপাশে থাকা কয়েকজন ছুটে আসছে দ্রুত পালিয়ে যান সেই যুবক।


বিজ্ঞাপন


গত মার্চের এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনামিকা হাতিরঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। তবে ঘটনার ৫ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ঘটনাটি ঘটানো সেই ব্যক্তির সন্ধান পায়নি। ওই ব্যক্তি আসলেই পুলিশ সদস্য ছিল না-কি এটি ছিনতাইয়ের কোনো কৌশল ছিল- তাও জানা যায়নি।

সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে অনামিকা জানান, বিদেশি একটি মোটর কোম্পানির আয়োজনে ব্যাডমিন্টন খেলায় অংশ নিয়ে রাতে নিজের বাইকে করে হাতিরঝিলের সড়ক হয়ে বাসায় ফিরছিলাম। কিন্তু হাতিরঝিলের এফডিসির যে পয়েন্টে চক্রাকার বাসগুলো থামে, সেখান থেকে ১০০ গজ সামনে আসা মাত্র হেলমেট ও মুখে মাস্ক পরা ওই ব্যক্তি আমাকে ফলো করা শুরু করেন।

অনামিকা বলেন, ওই ব্যক্তির গায়ে নীল জ্যাকেট ছিল। সেই সঙ্গে বুক পকেটে একটি পুলিশের সদৃশ লাল-নীল রঙের লাইট জ্বলছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ওই ব্যক্তি কোনো পুলিশ সদস্য। মোটরবাইক নিয়ে আমার সামনে এসেই তিনি বলেন, আমার কাছে না-কি অবৈধ কিছু রয়েছে। এ জন্য পাশের ট্রাফিক বক্সে যেতে হবে। ওই সময় আমার বাইকের চাবি ছিনিয়ে নেওয়ার পর মোবাইলও নেওয়ার চেষ্টা করলে আমি বাধা দেই এবং লোকজনের সহযোগিতার জন্য চিৎকার করতে থাকি। একপর্যায়ে কয়েকজনকে ছুটে আসতে দেখে সেই ব্যক্তি দ্রুত মোটরসাইকেলের চাবি দিয়ে নিজের বাইকে চড়ে উল্টোপথে পালিয়ে যান।


বিজ্ঞাপন


অনামিকাই প্রথম নন, রাজধানীতে কখনো পুলিশ আবার কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে গত কয়েক মাস ধরেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই চক্র। তাদের টার্গেটই মূলত একা চলাচলকারী নারী বাইকাররা। নগরীর প্রধান সড়ক কিংবা জনসমাগম কম এমন এলাকায় কোনো নারী একাকী চলাচল করলেই চক্রটি তাদের পিছু নেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়েই মোটরসাইকেল-মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যায়।

Special Reportসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থীকেও শ্যামলী এলাকা থেকে একইভাবে দিন-দুপুরে মোটরসাইকেলে তুলে নেওয়া হয়। এরপর সেই তরুণীকে দিয়াবাড়ি এলাকায় নিয়ে গিয়ে সঙ্গে থাকা সবকিছু লুটে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নির্যাতনের চেষ্টা করা হলে ওই শিক্ষার্থী উপস্থিত বুদ্ধির কারণে রক্ষা পান বড় বিপদ থেকে। অবশ্য, আলোচিত এই ঘটনার পর ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এমন ঘটনায় বরাবরের মতোই প্রশ্ন উঠছে ঢাকার রাস্তায় দিনে কিংবা রাতে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে। কারণ, বেশিরভাগ ঘটনাতেই আসামিরা অধরাই থেকে যাচ্ছে। এতে ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি সচেতন মহলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়ছে।

গত মার্চের সেই ঘটনায় অনামিকার করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) পর তদন্তেও নেমেছিল পুলিশ। এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তা অনামিকাকে নিয়ে ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছেন। সেই সঙ্গে পুরো হাতিরঝিল এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে থাকা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাও যাচাই করেছেন। তবে তার ভাষ্য- ওই ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আসাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি নিজেই ওই মেয়েকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পুরো হাতিরঝিল এলাকায় থাকা সিসি ক্যামেরা যাচাই করে তেমন কাউকে খুঁজে পাইনি। ওই ব্যক্তি পুলিশ ছিলেন কি-না তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’

যদিও পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, হাতিরঝিলের বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা বসানো হলেও তার অর্ধেকেরও বেশি অকেজো। ফলে অপরাধীরা যেসব পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা কাজ করে না বা দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট, সেখানে ওঁৎ পেতে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা কখনো হত্যা, পেছন থেকে হামলা, ছিনতাই কিংবা জিম্মি করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুটের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এতে গত কয়েক বছরে হাতিরঝিল থানায় রাতের আঁধারে ছিনতাই ও সর্বস্ব লুট নিয়ে কয়েক শতাধিক জিডি হয়েছে। তবে তদন্তে কোনো কূলকিনারাই পায়নি পুলিশ।

এদিকে, এমন সব ঘটনার ভুক্তভোগীদের অনেকেই আবার জিডি কিংবা মামলাও করছেন না। পুলিশের প্রতি আস্থা কম থাকাসহ মামলার পর আদালতের দৌড়ঝাঁপের মতো ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতেই অভিযোগ করেন না তারা। আবার যারা অভিযোগ করছেন, তাদের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত না করারও অভিযোগ রয়েছে অনেকের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন ঘটনার শিকার দুই ভুক্তভোগী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটেছে। থানায় ভয়ে বিষয়টি জানাইনি। কি হবে জানিয়ে। অপরাধী ধরতে পুলিশের তো আগ্রহ নেই। আমি মেয়ে মানুষ। সেই ভয়ে আর বিষয়টি জানাইনি।’

অন্যদিকে, এমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে এ বিষয়ে তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো ফিরতি জবাব দেননি। সেই সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগ থেকেও এ বিষয়ে কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিষয়টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ভুয়া পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কাউকে তুলে নেওয়া বা জিম্মি করে ছিনতাই কিংবা অপহরণের মতো ঘটনাগুলো আসলে একটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য অশনিসংকেত। অপরাধগুলো বেড়েই চলেছে। কারণ, এর নেপথ্যের কারণগুলো খুঁজে বের করে সেই অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন না। এর ফলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সঙ্গে অপরাধও বাড়ছে।

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এ ধরনের অপরাধগুলোর নেপথ্যের পটভূমি তদন্ত করতে অনেক সময় লেগে যায়। কারণ, এসবের কোনো তথ্য বা সূত্র পাওয়া যায় না। অথবা ভিডিও ফুটেজ বা তদন্তে সহায়ক কোনো উপকরণও বেশিরভাগ সময়ে থাকে না। আবার অনেক সময় ভুক্তভোগীও ভালোভাবে সহায়তা করেন না। সবমিলিয়ে এসব ঘটনার অপরাধীদের ধরা সম্ভব হয় না। এ নিয়ে মাঝে মাঝেই অভিযান চালানো হলেও এতে এমন অপরাধ নির্মূল হয় না।

ড. তৌহিদুল হক বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি একটি রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হবে না কিংবা কোনো ধরনরে উদ্যোগ নেওয়া হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এমন অপরাধগুলো বাড়বেই। তাই সবার আগে নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া এই অপরাধীদের শনাক্ত বা নির্মূল করাও সম্ভব না। তবে যদি অপরাধী অভিযোগকারীর জীবনের জন্য হুমকি বা ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর নাম-ঠিকানা গোপন রেখে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে অনেকাংশেই এসব অপরাধ কমে আসবে। অন্যথায় কোনোভাবে এইসব অপরাধ ও অপরাধীকে নির্মূল করা সম্ভব নয়।

ভুক্তভোগীদের পরামর্শ দিয়ে এই সমাজ বিজ্ঞানী বলেন, ভুক্তভোগীদের উচিত হবে এমন অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি বা নিরাপতাহীনতায় ভুগলে থানায় জিডি করা। আর ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যেন অভিযোগটি গুরুত্ব সহকারে দেখেন। আমরা অনেক সময় দেখি অভিযোগ করা হলেও পুলিশ সেটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখে না, প্রক্রিয়া দীর্ঘ করা হয়- এমন যেন না হয়। তবে সাধারণ ব্যক্তির যেসব পথে গেলে ঝুঁকি থাকে সেসব সড়ক এড়িয়ে চলাই উত্তম। সেই সঙ্গে জীবনের নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি হতে পারে এমন কাজ থেকেও বিরত থাকা উচিত।

এমআইকে/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর