শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ঐতিহ্যের ভিক্টোরিয়া পার্ক: ছিনতাইয়ের হটস্পট, ডেন্ডিখোরের আস্তানা

বোরহান উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন অনু
প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৫৬ পিএম

শেয়ার করুন:

ঐতিহ্যের ভিক্টোরিয়া পার্ক: ছিনতাইয়ের হটস্পট, ডেন্ডিখোরের আস্তানা

ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া পার্ক পরবর্তীতে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’ হিসেবে নাম পায়। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত পার্কটি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। ঐতিহ্যবাহী পার্কটি ২০২০ সালে সাজানো হয় নতুন আঙ্গিকে। বিপুল অংকের টাকা খরচ করে সংস্কারের মাধ্যমে এর আধুনিকায়ন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

৮৫ কাঠারও বেশি আয়তনের পার্কটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও দিনে দিনে অনিরাপদ হয়ে উঠছে দর্শনার্থীদের জন্য। কারণ আগে লোহার গ্রিল দিয়ে পুরো পার্ক আটকানো থাকলেও এখন পুরোটা খোলা। এই সুযোগে পার্কে আসা মানুষদের প্রায়ই পড়তে হয় ছিনতাইকারীদের কবলে। শুধু তাই নয়, সংস্কারকাজ শেষ হওয়া এই পার্কে বেড়েছে নানাধরণের অপরাধ। অনেকটা অপরাধীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে এই পার্কটি।

তাই এখানে আসা-যাওয়া করা সবার দাবি, পার্কটিতে যাতে করে আগের মতো লোহার গ্রিল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। তাহলে অপরাধ কমে আসবে।

পার্কে আসা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব সকালে এবং সন্ধ্যা হলেই বেড়ে যায় ছিনতাই। পার্কে আশ্রয় নেওয়া ভবঘুরে প্রায় অর্ধশতাধিক নানা বয়সী ছেলে-মেয়ে এই অপরাধের মূলহোতা।

Victoria-Park

পার্কে আলোর স্বল্পতার কারণে অন্ধকার জায়গায় চলে মাদক সেবন। রাত বাড়লে ভবঘুরে নারী-পুরুষরা অসামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়েন পার্কটিতে। আর আঠা জাতীয় দ্রব্য দিয়ে বানানো ডেন্ডি খেয়ে নেশায় বুধ হয়ে পড়ে থাকে শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সীরা।


বিজ্ঞাপন


বিশেষ করে দীর্ঘদিন আস্তানা গড়ে তোলা ডেন্ডিখোররা যেন পার্কে আসা মানুষের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্কের ঠিক পূর্ব পাশে মাদকাসক্তরা মাদকের আখড়া বানিয়ে ফেলেছে। একসাথে নারী, পুরুষ, বাচ্চারাসহ সকলে বসে বিভিন্ন রকম নেশা জাতীয় মাদক গ্রহণ করে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদের দিকে তেড়ে আসে। পার্কের পূর্বপাশটাকে তারা নিজেদের মতো করে গড়ে তুলেছে আস্তানা। এসব দৃশ্য দেখে বিব্রত হতে হয় পার্কে আসা নারী-পুরুষদের।

এছাড়াও নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ফেরিওয়ালা, টিকটকারদের উৎপাতও রয়েছে পার্কটিতে। আর মেয়েঘটিত বিষয় নিয়ে মারামারির ঘটনা তো অনেকটা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

dhaka

অথচ এসব যেন দেখার কেউ নেই৷ পার্কটির আশপাশের তিনজন প্রভাবশালী কাউন্সিলর আছেন। তারাও কেউ দায় নিতে রাজি নন। পার্কটি যে কার আওতায় পড়েছে তা নিয়ে যেন তিনজনের মধ্যে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।

অন্যদিকে পার্কটির পাশের দুই থানার পুলিশও এমন ঘটনা দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন। উল্টো ছিনতাইসহ এমন অপরাধের ঘটনা ঘটছে না বলে দাবি সূত্রাপুর থানা পুলিশের।

Victoria-Park

সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মইনুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। ড্যান্ডিখোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সমাজসেবা অধিদফতরের সাথে আলোচনা করেছি। আমাদের এডিসি স্যার এ ব্যাপারে খুব তৎপর।

ছিনতাইয়ের বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, এ ধরণের কোন ঘটনাই ঘটে না। এরকম কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।

অবশ্য পার্কটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সবসময়ই থাকেন। পুরো এলাকা খোলা থাকায় এমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও কঠিন তাদের পক্ষে। আবার ডেন্ডিখোরদের বলপ্রয়োগ করে পার্ক থেকে সরিয়ে দিলে অনেকে সে দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কাও আছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। ফলে পার্কে থাকলেও তাদের বেশিরভাগ সময় স্মার্টফোন চালিয়ে আর নিজেদের মধ্যে খোশগল্প করে সময় কাটাতে দেখা যায়।

একজন পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডেন্ডিখোরগুলোর যন্ত্রণায় আমরাও অতিষ্ঠ। এখন ওদের পিটাইয়া বের করে দিলে আপনারাই ভাইরাল করে দেবেন।

সকাল হলে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নিয়মিত শারীরিক কসরত করেন। বিকেল থেকে রাত অবধি চলে ব্যায়ামের কার্যক্রম। 

এই পার্কের চারপাশ ঘিরে রয়েছে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠগুলো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ, সেন্ট জেভিয়ার্স গার্লস স্কুল,  কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, পোগোজ স্কুল।

Victoria-Park

এছাড়াও এ পার্কের পাশ দিয়ে প্রতিদিন হাজারো পথচারীর আনাগোনা। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের জন্য সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ব্যবহারের কারণে এই পার্কের পাশ ঘেঁষে যেতে হয়। এছাড়াও পার্কের পাশে রয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কোর্ট-কাচারি।

সম্প্রতি পার্ক থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীর মোবাইল ছিনতাই, ব্যাগ টেনে নিয়ে যাওয়া, টাকা চুরিসহ নানাধরণের অভিযোগ এসেছে ঢাকা মেইলের কাছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী ঢাকা মেইলকে বলেন, সকালের দিকে ক্যাম্পাসে প্রবেশের সময় আমার গলা থেকে টান দিয়ে চেইন নিয়ে চলে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও চেইন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, দুপুরের দিকে আমি পার্কে বসে আমার বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম পাশে আমার ব্যাগ রাখাছিল। একটু পরে তাকিয়ে দেখি আমার ব্যাগ নেই। ব্যাগের মধ্যে কোর্টের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও ফাইল ছিল। যা আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

Victoria-Park

মানিকনগর থেকে আসা জান্নাতুল ফেরদৌস ঢাকা মেইলকে বলেন, বাচ্চাকে নিয়ে সকালে সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে আসতে হয়, স্কুল ছুটি হাওয়ার আগ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া পার্কে আমরা অভিভাবকরা অপেক্ষায় বসে থাকি। আশপাশে ডেন্ডিখোররা অপ্রীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। যা আসলে কোনো সচেতন মানুষ দ্বারা এসব কাজ করা সম্ভব নয়। আমরা এর প্রতিকার চাই। 

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোবাইল ছিনতাইসহ নানা দূর্ভোগের বিষয়ে ঢাকা মেইলে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। 

দায় নিতে চায় না কমিশনাররাও

ভৌগলিকভাবে এই পার্কটির একাধিক ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে আশপাশের তিন ওয়ার্ড কমিশনারের এরিয়াতে পড়েছে পার্কটি। অবশ্য কেউ যেন তা স্বীকারও করতে চান না।

উল্টো এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রতিবেদকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেন কেউ কেউ। 

পার্কের এসব অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আবদুর রহমান মিয়াজী ঢাকা মেইলকে বলেন, পার্কের জায়গা আমার ওয়ার্ডের আওতায় না। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।

৪২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, পার্কের বিষয়ে আমরা কী করব? এসব দেখার দায়িত্ব কী আমার? আমাকে কেন ফোন করেছেন। এ বিষয়ে কোন কথা বলব না। ফোন রাখেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এই জনপ্রতিনিধি।

Victoria-Park

আর ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আরিফুর রহমানকে বেশ কয়েকবার কল দিলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। 

এদিকে পার্কের অসামাজিক কার্যকলাপ প্রসঙ্গে সূত্রাপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, এরকম কাজ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। পার্কে সব জায়গা আলোকিত। পার্কের ভিতরে আমাদের ফোর্স থাকে সবসময়। 

কী বলছেন এলাকাবাসী

নিয়মিত পার্কে আসা যাওয়া করেন এমন একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা চান পার্কটির চারপাশে আগের মতো লোহার গ্রিল দিয়ে আটকে দেওয়া হোক। এতে অপরাধ কমে আসবে।

এজন্য তারা ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস পাওয়া যায়নি। 

তারা বলছেন, আগে গ্রিল থাকায় পূর্বপাশের একটি মাত্র গেট ছিল। যেখানে এক জন গার্ড থাকত। সময় করে গেট খোলা হত। বাইরে পুলিশ থাকত। ফলে ভেতরে কেউ ছিনতাই করলেও গ্রিল বেয়ে পার হতে পারত না। একাধিকবার ছিনতাইকারী ধরা পড়ার ঘটনা ঘটেছে। আর তখন ডেন্ডিখোররা ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেত না।

শহিদুল ইসলাম নামের একজন ঢাকা মেইলকে বলেন, শুধু পার্কটি চারপাশ দিয়ে আটকে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে আগের মতো হয়ে যাবে ভিক্টোরিয়া পার্ক। আশা করি মেয়র বিষয়টি বুঝবেন।

প্রতিনিধি/বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর