তারের জঞ্জালে ‘যান্ত্রিক শহর’ রাজধানীর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মুক্ত আকাশের দেখা মেলা ভার! বিদ্যুতের খুঁটি তো যেন তারের ‘স্বর্গরাজ্য’। ডিস ক্যাবল, ইন্টারনেট কিংবা টেলিফোন লাইন- সব তারেরই দেখা মিলবে প্রতিটি খুঁটিতে। এছাড়াও নগরীর যত্রতত্রই ঝুলতে দেখা যায় ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক তার। ক্যাবলের ছড়াছড়িতে একদিকে যেমন চিরচেনা এই শহর হারাচ্ছে নিজের সৌন্দর্য, অপরদিকে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
যদিও বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব ঝুলন্ত তার মাটির নিচে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বহু আগেই। ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের (এনটিটিএন) উদ্যোগে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) কয়েক দফায় বৈঠকও হয়েছে। তবে নেই তেমন কোনো অগ্রগতি।
বিজ্ঞাপন
নগরবাসীদের ভাষ্য- ক্রমাগত বাড়ছে ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল। কোম্পানিগুলো নষ্ট তারের সংযোগ না খুলেই দিচ্ছেন নতুন সংযোগ। এতে ফুটপাতে হরহামেশাই ঝুলতে দেখা যায় তার। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকালে মুক্ত আকাশের তুলনায় তারের জঞ্জালেরই দেখা যায় বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে মোহাম্মদপুরে বসবাস করেছেন সীমা আক্তার। রাস্তায় যত্রতত্র ঝুলে থাকা এসব তারের ভোগান্তি নিয়ে কথা হলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সড়কে কমানো হয়েছে আলো। অফিস শেষে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছি, পথে পায়ে কিছু একটা আটকে ছিটকে পড়ি সড়কের ওপর। হাঁটুসহ শরীরের বেশ কয়েকটি স্থানে আঘাত পাই। পরে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে দেখি ইন্টারনেটের কাটা তারের অংশ।
আজিমপুরের বাসিন্দা খায়রুল বেগমের অভিযোগ- কর্তাব্যক্তিরা শহরে কনক্রিটের দালান তৈরি বা অনুমোদন দিতে যটতা মনোযোগী, নগরীর পরিবেশ বা সৌন্দর্য ফেরানো নিয়ে ঠিক ততটাই বেখেয়াল। সর্বত্র তারের ছড়াছড়ি কার ভালো লাগে?
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে মুশফারা আক্তার মুক্তা বলেন- দুই সিটি করপোরেশনও এ বিষয়ে ব্যর্থ। মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে তার কেটে দিলেও, এর স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক ঘণ্টা। ঘটনার পরপরই আবার নতুন তার লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর আমরা নগরবাসী ইঁদুর-বেড়াল খেলা দেখি। এ জঞ্জাল কেয়ামতের আগে সরবে না।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে- তার অপসারণে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ককে (এনটিটিএন) বারবার জানানো হয়েছে। তবে তারা সময়ক্ষেপণ করেই যাচ্ছেন। আবার সিটি করপোরেশন ব্যবস্থা নিয়ে সংযোগ বন্ধ রাখার মতো সিদ্ধান্ত নিলে নাগরিকদের ভোগান্তি দেখা দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২০ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ এবং ২০২১ সালের অক্টোবরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তার কাটার অভিযান শুরু হয়। যদিও কার্যক্রম খুব একটা আলোর মুখ দেখেনি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও কেবল অপারেটরস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)। বিভিন্ন দাবির মুখে একই বছরের ১৮ অক্টোবর মেয়র তাপসের সঙ্গে বৈঠকে বসে সংগঠনটি। সে সময় আশ্বাস দেওয়া হয়, গত বছরের নভেম্বরের মধ্যেই ঝুলন্ত তার অপসারণ করা হবে। তবে মাস গড়িয়ে বছরের বেশি সময় পেরলেও ঝুলন্ত তার অপসারণ করে মাটির নিচে নিতে পারেনি আইএসপিএবি ও কোয়াব।
২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ঘোষণা দেন- ওই বছরের পয়লা অক্টোবর থেকে ঝুলন্ত তার অপসারণ করা হবে। এমন ঘোষণার পর উত্তরাসহ বেশ কয়েটি স্থানে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তার অপসারণ করেন সেবাদাতারা। এ সময় মেয়র জানান- মাটির নিচ দিয়ে ক্যাবল নেওয়ার পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
যদিও সময় গড়ালেও অধিকাংশ স্থানেই এখনো রয়ে গেছে তারে জঞ্জাল। গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগে ধীরগতিতে শহরে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে সম্প্রসারিত হয়ে ঝুলছে বিভিন্ন সেবা সংস্থার তার। এতে প্রায়ই ছোটবড় নানা দুর্ঘটনাও ঘটছে।
এ বিষয়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এম এ হাকিম ঢাকা মেইলকে বলেন, তার অপসারণে এনটিটিএনের সঙ্গে আমাদের কাজ চলছে। আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বেশকিছু কাজ করেছি। এরমধ্যে উত্তরা জোনে আমাদের উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। তবে সেই তুলনায় আমার দক্ষিণ সিটি এলাকায় তেমন কাজ করতে পারিনি।
বিষয়টিতে নগর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, শহরে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে সম্প্রসারিত বিভিন্ন সেবা সংস্থার ঝুলন্ত তারের কারণে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটছে। সঙ্গে বিদ্যুতের তার থেকে অন্যান্য তার বিদ্যুতায়িত হয়ে অগ্নি দুর্ঘটনার শঙ্কা তো আছেই।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ঝুলন্ত তারের মাধ্যম বিভিন্ন নাগরিক সেবা- ডিস ক্যাবল, ইন্টারনেট, টেলিফোন, বিদ্যুতের তার ইত্যাদির সংযোগ এবং ব্যবস্থাপনা কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন সমেয় নানা দুর্ঘটনা ঘটে। সরকারি এবং বেসরকারি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের অপরিণামদর্শিতা, পরিকল্পনাহীনতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনাই মূলত এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সার্বিক পরিকল্পনা ছাড়া সাময়িক উচ্ছেদে ‘সাময়িক বাহবায়’ পুলকিত হলেও টেকসই সমাধান মিলছে না।
শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল নিরসনে সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাসহ ইউটিলিটি ডাক্ট (Utility Duct) পরিচালিত করতে হবে। যার মাধ্যমে সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের তারসমূহ একটি সমন্বিত গতিপথে শৃঙ্খলিত হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী নগর সরকার।
ডিএইচডি/আইএইচ