বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দ্রব্যমূল্যের ‘আগুনে’ কপাল পুড়েছে বিলাসী পণ্যের কারিগরদের

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:০৮ পিএম

শেয়ার করুন:

দ্রব্যমূল্যের ‘আগুনে’ কপাল পুড়েছে বিলাসী পণ্যের কারিগরদের
ছবি: ঢাকা মেইল

সারাক্ষণ নানা দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকেন আমিনুল ইসলাম (৩৫)। কিছুতেই যেন সমাধান পাচ্ছেন না। এই দুশ্চিন্তা ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। কারণ, উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম নিজের কাঠের ফার্নিচারের দোকানটিতে কাজ করেন ছয়জনের মতো শ্রমিক। যাদের মাসে মাসে পারিশ্রমিক দিতে হয়।

কাঠের ফার্নিচারের এই ব্যবসার বর্তমান বাজার বেশ মন্দা। আর এতেই নানা দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে আমিনুলকে। লোক কমাবেন কি-না সেই চিন্তাও করছেন। সেই সঙ্গে আছে- একটু একটু করে গুছিয়ে তোলা এই ব্যবসা সামনের দিনগুলোয় আদৌ টিকে থাকবে কি-না তার চিন্তা!


বিজ্ঞাপন


ময়মনসিংহের ভালুকার এই ব্যবসায়ীর মতো অনেক ফার্নিচার ব্যবসায়ীরাই এখন ভালো নেই। মন্দা ব্যবসার কারণে মন খারাপ সবার। সঙ্গে দোকান ভাড়া, শ্রমিকদের খরচ দিয়ে সংসার চালানোতেও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ফলে ইতোমধ্যেই কেউ কেউ শ্রমিকও কমিয়ে দিয়েছেন, আবার কেউবা ব্যবসা বন্ধ করে জাড়িয়ে পড়ছেন অন্য পেশায়।

Furnisherফার্নিচার ব্যবসায়ীদের যখন এই অবস্থা তখন কপাল পুড়েছে অনেক দারু শিল্পীদেরও। শুকনো কাঠের ওপরে খোদাই করে মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেন এই দারুশিল্পীরাই। আর সেই ‘শিল্প বেচেই’ চলে তাদের জীবন সংসার। মন ভালো নেই এই দারুশিল্পীদেরও। কারণ, নিত্যপণ্যের চাপে শখের পণ্য- কাঠের তৈরি চেয়ার-টেবিল, খাট-পালঙ্ক, শোকেস-আলমারি, ওয়ারড্রব, ড্রেসিং টেবিল, সোফাসেট সবই তৈরি কিংবা বিক্রিতে পড়েছে ভাটা।

মানুষের চাহিদার প্রেক্ষিতে দেশের শহর অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের বাজারেও একাধিক ফার্নিচারের দোকান গড়ে উঠেছে। একসময় বেচা-বিক্রিও হতো বেশ জমজমাট। সারারাত কাজ চলত এসব ফার্নিচারের দোকানে। এরমধ্যে দিনের চেয়ে রাতেই কাজ হতো বেশি। তবে এখন আর সেই চিত্র আগের মতো নেই। কাজের ব্যস্ততাও কম।

Furnisherসম্প্রতি শহর-গ্রামের বিভিন্ন ফার্নিচারের দোকান ঘুরে এমন তথ্যই মিলেছে। ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল ছাড়াও টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বিভিন্ন ফার্নিচারের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার পর থেকে ফার্নিচার ব্যবসায় যে ধস নামা শুরু হয়েছিল, তা ২০২১ সালের মাঝামাঝি কিছুটা কমতে থাকে। তবে চলতি বছরে এসে এপ্রিলের পর থেকে ব্যবসা আবার খারাপ হতে থাকে। এছাড়া বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে দেশের বাজারে সব ধরনের দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। সবমিলে মানুষ জীবনযাপনে অনেক হিসেব-নিকেশ করে চলছে। আর ফার্নিচার- শখের পণ্য, বিলাসী পণ্য। ফলে এসব পণ্যের বেচা-বিক্রিতে পড়েছে ভাটা। এতে অনেকেই এখন কাঠের ফার্নিচার তৈরিও বন্ধ করে দিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


আমিনুল ইসলাম বলেন, করোনার আগে যে বিক্রি হত, যে পরিমাণ অর্ডার পেতাম, সেটি আর কবে হবে জানি না। তাও মাঝখানে বেশ কিছুদিন বাজারটা ভালো ছিল। তবে এখন দেশের সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি, তাই বিক্রিও তেমন নেই। এ জন্য অনেকেই ফার্নিচার বানাচ্ছেন না।

আমিনুলের কথার প্রমাণ মিলেছে টাঙ্গাইল সখীপুর উপজেলার বড়চৌওনা বাজারে দুটি ফার্নিচারের দোকান ঘুরেও। সেখানে দেখা যায়- ক্রেতারা আসলেও দাম শুনেই চলে যাচ্ছেন। কেউ কিছু কিনছেন না বা অর্ডারও করছেন না।

এ বিষয়ে কথা হলে সখীপুরের ফার্নিচার ব্যবসায়ী আতিকুল ঢাকা মেইলকে বলেন, একটি খাট তৈরিতে চাহিদা অনুযায়ী ১০ হাজার থেকে লাখ টাকার ওপরে খরচ পরে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই সময়ে অনেকেই তাই কাঠের আসবাবপত্র কিনছেন না।

Furnisherএকই ধরনের তথ্য জানালেন অপর ফার্নিচার ব্যবসায়ী আমিনুরও। তার মতে, ক্রেতার পছন্দের ওপর কাঠের ফার্নিচারের দাম নির্ভার করে। কাঠ আর কাঠের ওপর যে নকশা হবে সেটির ওপরও মূল্য নির্ভর করে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি নরমাল (হালকা নকশা) আলমারি যদি বাগান কাঠের তৈরি করেন তবে খরচ হবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। যদি সেটি কাঁঠাল কাঠের হয় তবে খরচ ১০ হাজার বাড়বে। কারণ, বাগান কাঠের চেয়ে কাঁঠাল কাঠের দাম বেশি। আর যদি সেগুন হয় তবে খরচ দাঁড়াবে আরও ৫ থেকে ৭ হাজার বেশি। এ জন্য কেউ ওয়াল সোকেশ ২০ হাজারে কেনে, আবার কেউ অর্ডার দিয়ে তৈরি করে ৮০ হাজারে।

এদিকে, কালিয়াকৈর উপজেলায় ফুলবাড়ি বাজার ঘুরে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে দারু শিল্পীদের। এরমধ্যে অনেকেই কাজ না পেয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। নকশা কারিগর হীরেশ ঢাকা মেইলকে বলেন, ছোটবেলা থেকে নকশার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ৩০ বছর ধরে এই কাজ করেই কাটালাম। পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে চলে সংসার। পরিচিত অনেকেই এখন কাজহীন বসে আছে, যেখানে আগে একত্রে কাজ করতাম।

কাঠের ওপর নকশা তৈরি করা এই কারিগর বলেন, বেশি টাকা নেই তাই নিজের দোকানও নেই। তবে মালিকদেরও ব্যবসাও খারাপ।

Furnisherনারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের তিলচন্দী বাজার ফার্নিচার ব্যবসার জন্য এক নামে পরিচিত। এখানকার তৈরি ফার্নিচার দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ও খুচরায় বিক্রি হয়। করোনার পর থেকে মন্দাভাব কাটছে না এখানেও। অত্যন্ত সু-পরিচিত তিলচন্দী বাজারে প্রায় ২-৩শ’ ফার্নিচারের দোকান রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দোকানিরা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা থেকে ট্রাকযোগে বড় বড় গাছ কেটে এনে সেগুলো স’মিলে কেটে-ছেঁটে এসব ফার্নিচার তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। শাল, সেগুন, কেরোসিন কাঠ, একাশিয়া কাঠ, মেহগনি ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করে ক্রেতার পছন্দমতো ফার্নিচার তৈরি করে থাকেন তারা। কিন্তু করোনার কারণে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প ও ব্যবসায় মন্দাভাব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে এখন আর ফার্নিচার লোকজন খুব একটা কিনতে আসে না।

তিলচন্দী বাজারের ফার্নিচার ব্যবসায়ী হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, দোকানে মানুষের জায়গা দেওয়া যেত না বসার জন্য, আর এখন পুরোপুরি ফাঁকা। সব দোকানেই একই অবস্থা। মানুষের হাতে যদি টাকা থাকেও, বিলাসী পণ্য কিনে তা খরচ করছেন না।

বিভিন্ন জেলা ঘুরে যখন এই চিত্র দেখা গেছে তখন রাজধানীর পান্থপথের বিভিন্ন ফার্নিচারের দোকান ঘুরে জানা গেছে- এখানে কাঠের ফার্নিচার আছে, তবে মালয়েশিয়ান উড (কাঠ) কিংবা কানাডিয়ান উডের ফার্নিচার বিক্রি হচ্ছে বেশি। যদিও তাদের ব্যবসাও আগের মতো নেই। কিছুটা মন্দা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে খিলগাঁও তালতলা এলাকার ফার্নিচার ব্যবসায়ী জলিল ঢাকা মেইলকে বলেন, মানুষ অর্ডার দিচ্ছে না। রেডিমেড বিক্রি হচ্ছে কম। আসলে মানুষ একটু হিসেব করে চলছে। মানুষের কাছে খেয়ে-পরে ভালো অর্থ থাকলে শখের পণ্য কিনে থাকে। তবে এখন শখের পণ্য কিনছেন না মানুষ, তাই ব্যবসাও খারাপ যাচ্ছে।

Furnisherএই ফার্নিচার ব্যবসায়ীর কথার বাস্তব নজিরও মিলছে পড়ার টেবিল কিনতে আসা রাজধানীর বাসিন্দা আনোয়ার আজমের কথায়। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আমরা যারা মধ্যবিত্ত, তারা প্রয়োজনই মেটাতে পারি না, শখ পূরণ করি কখন বলেন? বাচ্চার টেবিল দরকার তাই টেবিল কিনলাম। একটা সিঙ্গেল খাটও খুব দরকার। তবে ১০ হাজার টাকা একত্রে করতে পারছি না। করতে গেলে সংসারে চুলা জ্বলবে না। সামনে দিন ভালো আসলে কিনব।

বাজারে সব জিনিসের দাম যখন চড়া তারমধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে নারাজ সবাই। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ফার্নিচার ব্যবসায়ীদেরই ‘মাথায় হাত’ পড়েছে। সবার মনে প্রশ্ন- আদৌ কি এই ব্যবসায় টিকতে পারবেন, না-কি জীবিকার তাগিদে ফার্নিচার ব্যবসা ছেড়ে খুঁজতে হবে ভিন্ন পেশা?

ডব্লিউএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর