রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘অপরাধী হলে বিচার করুন, তবু তাদের ফিরিয়ে দিন’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২২, ০৩:০৬ পিএম

শেয়ার করুন:

‘অপরাধী হলে বিচার করুন, তবু তাদের ফিরিয়ে দিন’

আমাদের প্রিয়জনরা অপরাধী হলে তাদের বিচার করুন। তবু ফিরিয়ে দিন। আর কতকাল আমরা তাদের অপেক্ষায় থাকবো। তারা বেঁচে আছে কি মরে গেছে আমরা তাও জানি না। মরে গেলে অন্তত লাশের এক টুকরো অংশ দিন, যা দিয়ে আমরা দাফন করতে পারব। হাত তুলে দোয়া করব, আমার প্রিয়জন মরে গেছে।

আক্ষেপ আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার পরিবারের স্বজনরা।


বিজ্ঞাপন


মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন তারা। সেখানে মানববন্ধনে কথা বলেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা। আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই মানববন্ধনে স্বজনদের আকুতি ও কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল।

‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত এই মানববন্ধনে সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম আঁখির সভাপতিত্বে গুমের শিকার পরিবারের স্বজনরা ছাড়াও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমাদুর রহমান মান্না, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাবিত আউয়াল ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বক্তব্য দেন।

এসময় বক্তারা বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনেরও দাবি জানান।

gum2


বিজ্ঞাপন


মানববন্ধনে বক্তব্য দেন ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বরে গুমের শিকার রাজধানীর সুত্রাপুর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহানা বানু মুন্নি। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাইকে ফেরত চাই। সে যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তবে তার বিচার করা হোক, কিন্তু তাকে গুম করে রাখার অধিকার এই রাষ্ট্রের নেই। সে অপরাধী হলে বিচার করুন, তবুও তাকে ফিরিয়ে দিন।’ 

২০১৯ সালের ১৯ জুন মিরপুরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফেরার পথে ইসমাইল হোসেন বাতেনকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় দাবি করে তার মেয়ে আনিসা হোসেন বলেন, ‘আজ তিন বছর তিন মাস হলেও এখন পর্যন্ত আমার বাবার কোনো সন্ধান পাইনি। তাকে খুঁজে পেতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালায় থেকে শুরু করে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমরা আবেদন করিনি। র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ হওয়ায় পুলিশ কমিশনার আমাদের আবেদনটা পর্যন্ত পড়েননি। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে প্রশ্ন, এই স্বাধীন বাংলাদেশে কি আমার বাবাকে খুঁজে পাবো না। যারা আমার বাবাকে তুলে নিলো তাদের বিচার কি হবে না?’

২০১৬ সালের ৯ আগস্ট রাতে রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসের একটি বাসা থেকে ব্যারিস্টার আরমানকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকে কিছু লোক। গুমের শিকার আরমানের মা ও স্ত্রী ছাড়াও স্বজনরা এসেছিলেন এই মানববন্ধনে।  এসময় ব্যারিস্টার আরমান হকের মা আয়েশা খাতুন বলেন, ‘প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যরা বাসায় আসেন। ফলে বাচ্চারা আর বাসায় ভয়ে থাকতে চায় না। তারা পড়াশোনা করতেও পারছে না। আরমানের দুই মেয়ে (যাদের বয়স ৯ ও  ১০ বছর) তারা ঘুমালেও দুঃস্বপ্ন দেখে তাদের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে, ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং ওদের মারধর করা হচ্ছে। এই ধরনের সাইকোলজিক্যাল ট্রমার মধ্যে তারা আছে। পুলিশ এসে বারবার জানতে চায় আপনার ছেলে কোথায়। কিন্তু তাদের বারবার বলার চেষ্টা করি, আপনারাই তো খোঁজ দেবেন সে কোথায় আছে। উল্টা তারা আমাদের জিজ্ঞাসা করে সে কোথায় আছে। আমার মূল দাবি একটাই, আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে পেতে চাই। যারা গুমের শিকার হয়েছেন তাদের উদ্ধারে একটি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সুস্পষ্ট বক্তব্যসহ তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক।’

gum4

গুমের শিকার কুষ্টিয়ার আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী ঢাকায় আজ থেকে সাত বছর আগে ১৫ আগস্ট ফুল দিতে এসে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। তখন থেকে আর খোঁজ মেলেনি। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, তাকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দিন, আমরা তাকে ফিরে পেতে চাই।’

মানববন্ধনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন যারা ক্ষমতায় আছে তারা প্যাঁচে পড়ে গেছে। তাদের কথা দেশে-বিদেশে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয়েছে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া তারা পরের সরকারকে মানবে না। এজন্য তারা বলছে বিএনপিকে নির্বাচনে আনা যায় কি না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলব, এই পরিস্থিতি চিরকাল থাকবে না।’

মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘যারা গুম হয়ে ফিরে এসেছেন তাদের এমন ভয়ভীতিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তারা এখন আর কোনো কথা বলতে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে চান না। এখান থেকে একটি কথাই বলতে চাই, যারা গুম হয়েছেন, ফিরে এসেছেন, যাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এইসব ঘটনায় যারা এখনও নিখোঁজ আছেন, তাদেরকে উদ্ধারের সরকারেরর পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। যাতে তাদের উদ্ধার করা যায়। এসব ঘটনায় আমরা চাই স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। এই অপরাধের সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা। যেসব বাহিনীর লোকজন জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।’

gum3

ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘মন্ত্রিসভার সদস্যরা মিথ্যাবাদী। আজ যদি বলি আপনারা তা লিখতে প্রচার করতে পারবেন না। সেই সক্ষমতা মিডিয়ার নেই। আজ এখানে যে ছোট বাচ্চারা তাদের বাবার জন্য কান্না করছে এই কান্না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সবার কানে পৌঁছালে তাদের রোদ বৃষ্টিতে ভিজে প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মানববন্ধন করতে হতো না।’

গুম দিবসের মানববন্ধনে স্বজনকে খুঁজে পাওয়া দাবি নিয়ে অন্যাদের সাথে রাজধানীর নাখালপাড়া থেকে এসেছিলেন গুমের শিকার তিতুমীর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী, সুত্রাপুর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লার বোন কানিজ ফাতেমা রিতা, সুত্রাপুর যুবদলের সভাপতি খালেদ হাসান সোহেলের স্ত্রী সাদিয়া সাম্মী সুলতানা, ইসমাইল হোসেন আলামিনের মা শিরিন আকতার, কাওসার হোসেনের পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে লামিয়া আকতার মিমসহ অর্ধশতাধিক পরিবারের সদস্যরা।

এমআইকে/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর