কবি ভবন তো ভেঙে ফেলা হলো। এখন নজরুলকে বাঁচিয়ে রাখতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তাকে নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা করা। নজরুল ইন্সটিটিউট নজরুল গবেষণায় কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে— জানতে চাইলে মো. জাকীর হোসেন গড়পড়তা উত্তর দিলেন।
কাঁটাতার ভেদ করে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এক সুতোয় গেঁথেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির মানসপটে এখনও তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাহিত্য-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবুও পশ্চিমবঙ্গের মতো এখানে নজরুল চর্চায় খামতি থেকে যাচ্ছে। এ নিয়ে নজরুল ইন্সটিটিউট যেন অনেকটা দায়সারা। জন্ম ও মৃত্যু দিবস ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চোখে পড়ে না।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল নজরুলকে। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের ৩৩০-বি ভবনে তাকে স্থায়ীভাবে বসবাসের বাড়ি দেওয়া হয়। ‘কবি ভবন’ নামে পরিচিত বাড়িটি এখন নজরুল ইন্সটিটিউট। নজরুল চর্চার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিকে বেছে নেওয়া হয়।
তবে এখন নজরুল ইন্সটিটিউটে গেলে নজরুলকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকারি কোনো অফিস ছাড়া কিছুই মনে হবে না। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নজরুল যে বাড়িটিতে ছিলেন সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে ১১তলা ভবন। এর ফলে কবি ভবনের শেষ চিহ্নটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। এখন যে ভবনটিতে প্রতিষ্ঠানের দাফতরিক কাজকর্ম চলছে সেটিও ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে যারা কবি ভবনের ভেতর কবিকে অনুভব করতে চাইবেন, তারা সে সুযোগ আর পাবেন না। কবিকে খুঁজতে হবে নতুন ভবনে স্থাপিত হওয়া জাদুঘরে। সেখানে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে কবির খাট, গ্রামোফোন, দুর্লভ আলোকচিত্রী ইত্যাদি।
প্রকল্পের নথি থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ জুলাই ভবন নির্মানের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। পরে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ করতে পারেনি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তৃতীয় দফায় ২০২৩ সালের ৩০ জুন সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে কাজের অগ্রগতি দেখে ওই সময়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা যায়। কারণ, প্রকল্প শুরুর চার বছরে এখনও পাইলিংয়ে আটকে আছে কাজ। পুরো প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
বিজ্ঞাপন
কাজের দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) আহমেদ শিবলী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রকল্পের অনুমোদন পেলেও কাজ শুরু করতে দেরি হয়। এ ছাড়া ভাবনের ডিজাইনের কিছু সমস্যা ছিল, এসব নানা কারণে কাজ পিছিয়ে যায়।’
নতুন নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী কাজ শেষ হবে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়াররা ভালো বলতে পারবেন। তারা আমাদের বলেছেন ভবনটি দাঁড়িয়ে যাবে ২০২৩ সালের দিকে। তবে জিনিসপত্রের যা দাম তাতে ঠিক সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় আছে। মেয়াদ আরও বাড়তে পারে।’
এদিকে প্রকল্পের উপ-সহকারি পরিচালক (সিভিল) শেখ মো. সোলায়মান জানালেন, ভবনে দুটি বেজমেন্ট থাকবে। প্রাথমিকভাবে চারতলায় জাদুঘর স্থাপিত হবে। সেখানে রাখা হবে নজরুলের ব্যবহৃত কিছু জিনিস। এ ছাড়া থাকবে আর্কাইভ, লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া ও ডরমেটরি। অফিস ফ্লোর থাকবে তিনটি।
দেশে শত শত বছর পুরোনো স্থাপনা আছে, যেগুলো না ভেঙে সংস্কার করে রেখে দেওয়া হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। নজরুলের ধানমন্ডির বাড়িটির ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ নেওয়া যেত না? প্রশ্নের উত্তর জানতে ঢাকা মেইল কথা বলে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক (অতি. সচিব) মো. জাকীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, জরাজীর্ণ হওয়ায় কবি ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। সংস্কার করেও বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যেত না।
কবি ভবন তো ভেঙে ফেলা হলো। এখন নজরুলকে বাঁচিয়ে রাখতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তাকে নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা করা। নজরুল ইন্সটিটিউট নজরুল গবেষণায় কতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে— জানতে চাইলে মো. জাকীর হোসেন গড়পড়তা উত্তর দিলেন।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘নজরুলকে নিয়ে গবেষণা চলছে। গবেষকরা আসছেন। বই-পুস্তক পড়ছেন। তারা গবেষণার বিষয় সাবমিট করছেন। সেটা ট্রাস্টি বোর্ড রিভিউ করছে। এ ছাড়া গবেষণাপত্র প্রকাশ করছি। বিভিন্নরকম অনুষ্ঠান করছি। বাংলাদেশ-ভারত সব জায়গায় মেলায় অংশ নিচ্ছি। আমরা মানুষকে আকর্ষণের চেষ্টা করছি। তবে মানুষকেও তো আকর্ষিত হতে হবে। আমি টেবিলে পোলাও-কোরমা সাজিয়ে রাখলাম, এখন আপনি যদি ক্ষুধার্ত না হন তাহলে কিন্তু খাবেন না। জিনিসটা অনেকটা এ রকম।’
জাকীর হোসেন জানালেন, ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নজরুল সম্পর্কিত বই দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে নাকি সেসব বই পড়ানো হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিদ্যালয়ে আমাদের তরফ থেকে বই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখেছি সেখানে বইগুলো পড়ানো হচ্ছে না। আপনি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানে বই আছে, কিন্তু তালা খুলে কেউ দেখছে না। জোর করে তো বই পড়ানো যাবে না। শুধু গবেষকের দোষ দিলে হবে না। পাঠক থাকতে হবে।’
সংগীতের আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নজরুল সংগীতও শুদ্ধভাবে গাইছেন না অনেকে। সুরের বিকৃতি করা হচ্ছে। এটা রোধে নজরুল ইন্সটিউটের ভূমিকা জানতে চাইলে জাকীর হোসেন বলেন, ‘নিয়মিতভাবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত সংগীত শিল্পীদের নিয়ে গঠিত টিম নিয়ে আমরা পথ দেখিয়ে যাচ্ছি। শুদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশ করেছি। ইতোমধ্যে দেড় হাজারের মতো শুদ্ধ স্বরলিপির বই প্রকাশ করেছি। শুদ্ধ নজরুল সংগীতচর্চায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তারপরও কেউ যদি সুর বিকৃত করেন, তাহলে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের কিছু করার নেই।’
নজরুল ইন্সটিটিউটে প্রবেশ করে নজরুলকে খুঁজে পাওয়া গেল না। নতুন ভবনে নজরুল কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে সাধারণের মনে? উত্তরে জাকীর হোসেন জানালেন, সেজন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরিতে অন্তত ১৬ হাজার বই আছে। সারিবদ্ধ তাকে বই সাজানো থাকলেও নেই কোনো পাঠক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারাদিন খালিই পড়ে থাকে লাইব্রেরি। মানুষ জানেন না যে, সেখানে এতবড় একটি লাইব্রেরি আছে। বাইরে বেরিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেল।
/আরএসও/