‘সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই আমার মাথায় নানা ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করতে থাকে। আমরা তো দেশছাড়া। এখানে অনেক কষ্টে দিন পার করছি। স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বসবাস করি। তীব্র পানির সংকট। পানির অভাবে ঠিকমতো গোসল দিতে পারি না। কর্তৃপক্ষ যা খাবার দেয় তাই খেতে হয়। অনেকটা অসহায় বন্দিদের মতো জীবনযাপন করতে হয় আমাদের। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তার কী হবে? সে কী পরিচয়ে বড় হবে? এই ধরনের দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো খাবার খেতে পারতাম না। সন্তান জন্ম হওয়ার পর ডাক্তার আপা বললেন বাচ্চার ওজন কম হয়েছে। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া না করায় পুষ্টিহীনতার কারণেই নাকি এমনটা হয়েছে।’
এভাবেই নিজেদের ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাহেদা (১৯)। অনেকটা আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতিনিয়ত আমাদের নানা ধরনের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আমার বাচ্চা গর্ভে আসার পর থেকে তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সে জন্ম নেওয়ার পর থেকে তাকে অনেক সংকট মোকাবেলা করে বড় হতে হচ্ছে। একটা সময়তো আমাদের সব কিছুই ছিল। এখন কিছুই নেই। ওরা আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। আমরা আবারও দেশে ফিরে যেতে চাই। এখানে থাকতে চাই না। আমাদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।’
বিজ্ঞাপন
সাহেদার মতো অনেক মা ও শিশুকে গর্ভাবস্তায় বা মাতৃগর্ভে থাকতেই নানা ধরনের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। একটি শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকছে তখন মা পাচ্ছে না পর্যাপ্ত সেবা-যত্ন। সন্তান পেটে নিয়ে অনেক কষ্টের সাথে দিন পার করতে হয় মায়েদের। অনেকটা অবহেলায় মাতৃগর্ভে বড় হতে থাকে শিশুটি। এরপর সন্তান জন্মদানের পর শরণার্থী পরিচয়ে অবহেলা অনাদরে বেড়ে ওঠা। সবমিলে পৃথিবীর আলো দেখার আগে অর্থাৎ মায়ের পেট থেকেই সংগ্রাম শুরু হয় রোহিঙ্গা শিশুদের। সন্তান পেটে নিয়ে নানা ‘চ্যালেঞ্জের’ মধ্য দিয়ে দিন কাটে মায়েদের।
সরেজমিনে টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত বেশ কয়েকজন শিশু ও বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়। এই ক্যাম্পের আট বছরের শিশু সুমাইয়া বলেন, ‘আজকে যদি নিজের দেশে থাকতাম, তবে অনেক মজা করে স্কুলে যেতে পারতাম। অনেক খেলাধুলা করতে পারতাম। আমার বাবা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতো। মা আমার জন্য কত ভালো ভালো খাবারই না রান্না করতো! অনেক জায়গায় ঘুরতে যেতে পারতাম। এখানে আমাদের খেলার জায়গা নেই। ঘোরাঘুরি করারও জায়গা নেই। পড়তেও ভালো লাগে না।’
ফাতেমা (২৭) নামে একজন নারী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের বাচ্চারা এখানে থাকতে চাচ্ছে না, তারা এখানে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছে না। ঠিকমতো খেলাধুলা করার জায়গা পাচ্ছে না। আমরা চাইলেও তাদের পছন্দমতো খাবার রান্না করে দিতে পারি না।’ ফাতেমা আরও বলেন, আজকে আমরা আমাদের দেশে থাকলে নিজের ইচ্ছামতো সবকিছু করতে পারতাম। এখানে আমাদের অপরের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়। আমরা আমাদের নিজের দেশে ফিরে যেতে চাই। আমাদের সন্তানদের জন্য হলেও নিজের দেশে যেতে চাই।’
বিজ্ঞাপন
রোহিঙ্গ ক্যাম্পে নির্দিষ্ট দিনে যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয় তা গ্রহণ করার জন্য শিশুদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। খাবারের ভারী বোঝা নিয়ে অনেক কষ্টে নিজের ঘরে ফেরেন তারা। এই ক্যাম্পের জাহিদ নামের ১২ বছরের এক শিশু বলেন, ‘এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবারের বস্তা নিতে ভালো লাগে না। বস্তা মাথায় নিয়ে ঘরে যেতে অনেক কষ্ট হয়।’
গরমের সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পানির সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের এই সমস্যার সম্মুখীন বেশি হতে হয়। তাহেরা (২৪) নামের একজন বলেন, ‘পানির খুব সমস্যা। খাবার আর অজুর পানি জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়। গোসলের কথা তো ভাবাই যায় না। ৮-১০ দিন পর একবার গোসল করি। পানির অভাবে আমাদের সন্তানরাও ঠিকমতো গোসল করতে পারে না।’
রোহিঙ্গাদের আগমনের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের আজকের এই দিনেই (২৫ আগস্ট) সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর সাত লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। এরমধ্যে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩। সরকারি হিসেব মতে বর্তমানে যা প্রায় ১১ লাখের কাছাকাছি।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বিশাল সংখ্যক এই রোহিঙ্গার বহরের প্রায় ৬০ ভাগই শিশু। এরমধ্যে শরণার্থী শিবিরগুলোয় স্কুল-বয়সী শিশুই রয়েছে প্রায় চার লাখ। বসবাসকারী ১১ শতাংশেরও বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টি এবং ৩০ শতাংশের বেশি শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে ভুগছে।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মা ও শিশুর পুষ্টিহীনতার বিষয়গুলো বারবার উঠে আসছে। যদিও সরকারসহ বেশ কিছু দেশীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। শুধু স্বাস্থ সুরক্ষার বিষয়টিই নয়। একটি শিশু বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় থাকে। যেগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশুরা। এসব ক্ষেতে অনেকাট চ্যালেঞ্জ নিয়ে বড় হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে-
শরণার্থী পরিচয়ে বেড়ে উঠা
জন্মের পর থেকেই রোহিঙ্গা শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শরণার্থী পরিচয়ে বেড়ে উঠা। কারণ, ক্যাম্পে জন্ম নেওয়ার পর একটি শিশু যখন কিছু বুঝতে শিখছে, ঠিক তখনই সে জানতে পারছে- যে সে একজন শরণার্থী। অথচ তার নিজেরও একটি দেশ আছে। যেখান থেকে তারা বাস্তুচ্যুত। যেখানে নিজেদের সুন্দর বাড়ি ছিল। পরিবার অনেক আভিজাত্যের সঙ্গে বসবাস করতো। এসব বিষয় স্বাভাবিকভাবেই শিশুটির মনে দাগ কাটছে।
আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস
অগ্নিকাণ্ড, বন্যা ও পাহাড় ধ্বসসহ প্রায় সারাক্ষণ বিভিন্ন ঝুঁকি ও আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। সবথেকে বেশি আতঙ্কে থাকে শিশুরা। ২০২১ সালের ২২ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালির তিনটি ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অনেক ভয়াবহ ছিল সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সেই দুর্বিষহ অগ্নিকাণ্ড যেন এখনো ভুলতে পারছে না শিশুর। এছাড়াও ২০২১ সালের ২৭ জুলাই ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। ওই সময় আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। সে সময় পানির স্রোতে ভেসে ক্যাম্প-১৮ এর এক শিশুর মৃত্যু হয়। বর্তমানেও সেই আতঙ্কের সঙ্গেই বসবাস করছে রোহিঙ্গা শিশুরা।
শিক্ষায় সংগ্রাম
রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। তারা এই আবদ্ধ পরিবেশে পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। ইউনিসেফের তথ্য বলছে- বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে প্রায় চার লাখ স্কুল-বয়সী রোহিঙ্গা শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে তিন লাখ শিশু তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে তিন হাজার ৪০০টি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে দুই হাজার ৮০০ টিই ইউনিসেফ সমর্থিত। যেখানে বেশিরভাগ শিশুই তথাকথিত ‘লার্নিং কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাপ্রোচ (এলসিএফএ)’ এর আওতায় শিখছে, যা প্রাথমিকভাবে চার থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রথম থেকে চতুর্থ গ্রেড সমমানের শিক্ষা নিশ্চিত করছে। এছাড়াও তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশকিছু উদ্যোগও নিয়েছে ইউনিসেফ।
এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, প্রায় এক লাখ স্কুল-বয়সী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে ক্যাম্পে বসবাসরত অভিভাবকরা বলছেন- আবদ্ধ পরিবেশে বড় হওয়া এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকায় শিশুরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে।
খেলাধুলার জায়গার সংকট
শরণার্থী ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা প্রত্যেকটি শিশুর সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ উন্মুক্ত খেলাধুলা। শিবিরে নেই কোনো বড় মাঠ কিংবা পার্ক। যদিও এখানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা খেলাধুলার জন্য অল্পকিছু ব্যবস্থা রেখেছে। তবে যেখানে তৃপ্তি হচ্ছে না শিশুদের। তারা উন্মুক্তভাবে খেলাধুলা চায়, মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে চায়।
সীমাবদ্ধ খাবার-দাবার
শিবিরে বসবাসরত কোনো বাবা-মা ইচ্ছে করলেই তাদের আদরের সন্তানদের পছন্দের খাবার রান্না করে দিতে পারেন না। যেখানে নিজ দেশে থাকার সময় যখন যেটা সন্তান চেয়েছে, সেটাই তৈরি করে দিয়েছেন। তবে রোহিঙ্গা শিবিরের চিত্র ভিন্ন। এখানে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য বাবা-মায়েদের তাকিয়ে থাকতে হয় অন্যের দিকে। যার প্রভাব পড়ছে শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও।
ছোট পরিসরে বসবাস বা আবদ্ধ জীবনযাপন
রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মের পর থেকেই একটি শিশুকে আবদ্ধ পরিবেশের মধ্যে বড় হতে হচ্ছে। শিশুটি যখন বুঝতে শিখছে, তখন তার জন্য প্রতিকূল পরিবেশ মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিশু বয়সে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা ছাড়াও উন্মুক্তভাবে চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে আবদ্ধ জীবন শিশুদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে এমন অনেকেই আছেন যারা নিজ দেশে খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো। তবে বর্তমানে তারা নিজেদের সন্তানদের নিয়ে খুব ছোট পরিসরে বসবাস করছেন। আর একটি শিশু যখন বড় হয়ে নিজেদের অতীত জানছে, তাদের মনে সেটি ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
মানসিক অবসাদ
রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নেওয়া বা এখানে বেড়ে ওঠা অধিকাংশ শিশুই বড় হচ্ছে মানসিক অবসাদ নিয়ে। প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিটি মুহূর্তে তাদের মনে নিত্য নতুন আকুতি। নানা চাওয়া-পাওয়ার সীমাবদ্ধতার কারণে একপ্রকার মানসিক অবসাদের ভুগেই বড় হচ্ছে তারা।
এছাড়াও আরও অনেক সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিশুরা।
এসব বিষয়ে কথা হলে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা সাইয়্যেদ আবুল ফারাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রোহিঙ্গা শিশুরা একটা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। এখানে আবদ্ধ জীবনযাপন, ঘনবসতির পরিবেশ, উন্নত শিক্ষা-চিকিৎসাসহ নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে শিশুরা বড় হচ্ছে।’
সাইয়্যেদ আবুল ফারাহ বলেন, প্রতিকূল পরিবেশে অনেক শিশুই ছোট-খাট ইনকাম জেনারেট কাজের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতে করে শিশুশ্রম বা শিশুদের ওপর একটা বার্ডেম চলে আসে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- তারা একটা মানসিক ডিপ্রেসের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে চায় এবং এর মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
এদিকে, পরিবার-পরিজন হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়া এসব শিশু এখন পাচার, বাল্যবিবাহ ও নানা ধরনের নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অভিভাবকহীন প্রায় ৩০ হাজার শিশু রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাম্পগুলোতে এসব শিশু ঈদ উদযাপন করলেও তাদের মনে কোনো আনন্দ ছিল না। এ সময় তাদের স্মৃতিপটে ভেসে উঠে ভয়ানক সব ঘটনা। মা-বাবাকে হারানোর বেদনাদায়ক স্মৃতি। মা-বাবা হারা, মা অথবা বাবা হারা শিশুরা দিনটিতে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। তারা অঝোরে কেঁদেছে। তাদের চোখে-মুখে আজও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে।কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া প্রতি দু’জনের মধ্যে একজন শিশু ভয়াবহ সহিংসতার কারণে মাকে হারিয়েছে ও পরিবারহীন হয়েছে। এতে বলা হয়, এসব শিশু আজও সেই ভয়ংকর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। তারা খাদ্যাভাব, শোষণ ও নির্যাতনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের কক্সবাজারের মিডিয়া ও কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর ফারজানা সুলতানা জানান, ‘১৩৯টি অভিভাবকহীন রোহিঙ্গা শিশু নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন। মিয়ানমারের সহিংসতার পর শিশুদের নিয়ে এটি সবচেয়ে বড় গবেষণা। নৃশংস ঘটনায় ৬৩ শতাংশ শিশু অভিভাবককে হারিয়েছে। বাংলাদেশে আসার পথে ৯ শতাংশ শিশু পরিবার ও অভিভাবককে হারিয়েছে। ৫০ শতাংশ শিশু বলেছে, অভিভাবক ও পরিজনদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের অনেকে আবার হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী।’
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শিশুদের 'রাষ্ট্রহীন' শিশু বলে আখ্যায়িত করেছে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর। শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানরত শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই শিশুরা হতাশা ও নৈরাশ্যের ঝুঁকিতে আছে। বৈশ্বিক সমাজ হিসেবে আমাদের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা অপরিমেয়। রোহিঙ্গা শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে তাদের সুন্দর জীবন গঠনে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন।’
ইউনিসেফ বলছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের কোনো পরিচয় বা নাগরিকত্ব নেই; বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুদেরও নিবন্ধন হচ্ছে না। মিয়ানমারে তাদের বসবাসের পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত শিশুরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাঠ্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফোর বলেন, ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু এটি প্রয়োজনের চেয়ে বিন্দুমাত্র। শিশু ও তরুণদের শিক্ষা ও দক্ষতাবিহীন রাখা যায় না। কারণ, তারা নিজেরা বেঁচে থাকার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে; তাদের কমিউনিটিও টিকে থাকবে।’
জাতিসংঘের দূত আল মেরাইখির বলেন, ‘পরিচয় না থাকায় রোহিঙ্গা শিশুরা পাচারকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের অনুকম্পায় রয়েছে। এই মুহূর্তে সম্মিলিতভাবে এই রোহিঙ্গা শিশু ও তরুণ প্রজন্মের সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজন। যাতে তারা নিজেদের জীবন পরিচালনা করতে পারে এবং মিয়ানমারে ফিরে যেতে সক্ষম হয়ে উঠে।’
টিএই/আইএইচ