বুধবার, ১ মে, ২০২৪, ঢাকা

সাড়ে ৩ কোটি কিশোর-কিশোরী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যে অজ্ঞ

বেলাল হোসেন রাজু
প্রকাশিত: ১৮ আগস্ট ২০২২, ০৮:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

সাড়ে ৩ কোটি কিশোর-কিশোরী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যে অজ্ঞ

বয়ঃসন্ধিকালে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে দেশের মোট জনসংখ্যার বিপুল অংশ শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে বিরাট এক অংশ নানা রকম বদঅভ্যাসে জড়িয়ে পড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার ওপর। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে পর্ণ দেখা এবং বিকৃত যৌন আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। এ নিয়ে নতুন করে সামাজিক সংকট দেখা দিচ্ছে।

ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে দেখা যায় উঠতি জনসংখ্যার বিপুল এক অংশ মানসিক অবসাদে ভুগছে। ঢাকা মেইল এদেরই একজনের কাছে জানতে চেয়েছিল। তিনি বলেন, দিনে কয়েকবার পর্ণ ফিল্ম দেখা হয়। ছেলেটি অকপটে জানায় বলতে পারেন- নবম শ্রেণিতে থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এখন প্রায়ই দেখি। শুরুর দিকে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেও এখন একা একা বেশি দেখা হয়। তবে এটা থেকে মুক্তি চাই, কিন্তু এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে অনেক চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছি না। পরিবারের সঙ্গে শেয়ারও করতে পারছি না। খুব আন-ইজি লাগে। তবে আমি এখন জানি- এটা স্বাস্থ্যগত এবং ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু চেষ্টা করেও আমি এই অভ্যাস ছাড়তেই পারছি না।


বিজ্ঞাপন


কথাগুলো বলছিল রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী জায়েদ (ছদ্মনাম)। শুধু জায়েদই নয়, তার মতো লাখো শিক্ষার্থী পর্ণ, স্বমেহন ও অনিরাপদ যৌন-আচরণসহ নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে শারীরিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে কৈশোরকাল অতিবাহিত করেছে।

ডিজিটাল আদমশুমারি ২০২২ এর তথ্য মতে, ২০০১ সালে দেশে ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১১ সালে তা মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে দেশে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৬ জন, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশ। এই বিশাল সংখ্যক কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা, জীবন-দক্ষতা ও স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তারপরেও যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না তারা। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে উদ্যোগ থাকলেও, নেই এর যথাযথ বাস্তবায়ন।

Special

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের শরীরে ও মনে নানা ধরণের পরিবর্তন শুরু হয়। এমন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে কৌতূহলের বসে বা অসৎ সঙ্গে ধূমপান ছাড়াও মাদকাসক্তি, অনিরাপদ যৌন-আচরণের মতো নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয় কিশোর -কিশোরীরা। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় এসব কারণে প্রজননতন্ত্রে নানা ধরণের রোগ সংক্রমণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকি সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেছেন যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি গেইজ’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণাই নেই। স্কুল পাঠ্যক্রমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ঠিকভাবে শেখানো হয় না। গবেষণাকালীন শতকরা ১৭ ভাগ কিশোর ও ২৭ ভাগ কিশোরী ঠিকমতো কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির নাম বলতে পেরেছে। আর মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাব ও প্রজনন স্বাস্থ্য যেন এক ধরণের ট্যাবু (নিষিদ্ধ)। ছেলেদের ক্ষেত্রে শারীরিক পরিবর্তন আরও ভয়াবহ। শুধু বাবা-মা নয়, স্কুলের শিক্ষকরাও তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংকোচবোধ করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, যুগ যুগ ধরে চলা এমন সামাজিক জড়তার কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিজ্ঞানসম্মত কোনো জ্ঞান ছাড়াই কৈশোরকাল পার করছেন। এ জন্য ‘যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ জ্ঞান প্রয়োজন। এই জ্ঞান হলো, কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা দেওয়া এবং যত্ন নেওয়ার জ্ঞান। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা, সন্তান জন্মদানের জন্য গর্ভধারণ, পরিবার পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নির্বাচন, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে জানা, আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া।

এমন বাস্তবতার মাঝেই প্রতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য দিবস’ পালিত হয়। তবে বাংলাদেশে অন্য দিবসের মতো হইচই করে এ দিবসটি পালনে তেমন কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না।

দেশে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপটিক অ্যাবরশন (বাপসা)। বাপসার প্রকল্প ব্যবস্থাপক শামিমা আখতার চৌধুরী এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘অল্প বয়সী ছেলেরা গনোরিয়ায় ভুগছে। মেয়েরা প্রেগন্যান্ট হচ্ছে কিছু না বুঝেই। আবার প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল ধারণার কারণেই মানসিক অবসাদে ভুগছেন অনেকে। তবে সচেতনতামূলক কাজে কিশোর-কিশোরীদের কাছ থেকে সাড়া পেলেও, তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।’

শামিমা আখতার চৌধুরী আরও বলেছিলেন, শহর থেকে নগর পর্যন্ত সব স্থানে কিশোর-কিশোরীরা অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট, পর্নোগ্রাফিক কন্টেন্ট দেখছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভুল শিখছে। যার প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্যে, পরিবার বা সমাজের ওপর। শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, অনেক প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে রয়েছে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা। এই অসচেতনতা হয়তোবা অনেকের ক্ষেত্রেই সত্য।

Special

এ জন্য কিশোর-কিশোরীদের যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষজ্ঞরা বেশকিছু বিষয়ে সুপারিশও করেছেন। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- মাধ্যমিক থেকে শুরু করে সব ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থায় যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, বিশেষ করে তৃতীয় লিঙ্গ ও শারীরিক মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোর-কিশোরীদের বিবেচনায় রেখে কারিকুলাম তৈরি করতে হবে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে হবে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে, পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দিকেও নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি, উন্নয়নসহ অনেক বিষয় জড়িত। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষকদের ওপর। তাঁদেরকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে, তবেই তাদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরাও এ বিষয়ে সুশিক্ষা পাবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কারিকুলামে প্রয়োজনীয় সংস্কার, শিক্ষকদের জেন্ডার সংবেদনশীল যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং অধিকার সংক্রান্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য যথাযথ দক্ষ করে তুলতেও তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে জরুরি বিষয়গুলো সংযুক্ত করারও পরামর্শ দিয়েছেন।

Special

যদিও বর্তমানে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা নেই। এমনকি নেই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমেও। শুধু আছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা নামে একটি বই। তাও আবার অসম্পূর্ণ বা আংশিক। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে নতুন কারিকুলামের রিভিশন চলছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এটি বাস্তবায়ন করা হতে পারে।

এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গবেষক নাজমুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা নিয়ে প্রাথমিকে কোনো পাঠদান নেই। মাধ্যমিকে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বইয়ে কিছু বিষয় যুক্ত আছে। তবে বিস্তারিতভাবে নেই। সাপ্লিমেন্টারি বই হিসেবে যুক্ত করা যায় কি না সে বিষয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে আমাদের কয়েকবার মিটিং হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে আরও পাঁচ দিনের একটা বিস্তারিত মিটিং হবে, তখন বিস্তারিত বলতে পারব।

বিষয়টিতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ্ ঢাকা মেইলকে বলেন, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন এবং শারীরিক ক্ষতির কথা বিবেচনা করে কিশোর-কিশোরীদের এই বয়সে যৌন আচরণের ক্ষেত্রে সংযত থাকা উচিৎ। পড়াশোনা, খেলাধুলার পাশাপাশি স্ব স্ব ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে কিশোর-কিশোরীরা অনেক ক্ষেত্রেই সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারবে।

গোটা দেশের এই সাড়ে তিন কোটি জনগোষ্ঠী তাদের কৈশোরকালীন সময়টা যখন পার করে, তখন কিন্তু তারা ঠিক আর শিশুদের কাতারে পরে না, আবার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেও তাদের গণ্য করা হয় না। তাদের জীবনের এই পর্যায়টা একটি সংবেদনশীল অধ্যায়। তাই মোট জনসংখ্যার এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কিংবা দীর্ঘ মেয়াদী সাফল্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

বিএইচআর/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর