মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

ভাষাসৈনিকের নামে সড়ক থাকলেও নেই পরিচিতি

দেলাওয়ার হোসাইন দোলন
প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:০২ এএম

শেয়ার করুন:

ভাষাসৈনিকের নামে সড়ক থাকলেও নেই পরিচিতি

ধানমন্ডি সালাম’স কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সোমা। গন্তব্য ধানমন্ডি জেনারেল অ্যান্ড কিডনি হাসপাতাল। গুগল ম্যাপ দেখে সোমা সড়কের নাম ‘ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সড়ক’ বললেও রিকশাচালক কিছুতেই চিনতে পারছেন না। হাসপাতালের নাম বলার পর চালক বললেন- ‘ও আপা এটা সাত নম্বর সড়ক, আগে কইলে তো এতো ঝামেলা পোহাতে অইত না চিনতে।’

পথ খুঁজে পেতে বিড়ম্বনার কথা জানাতে গিয়ে গৃহিণী সোমা বলেন, চিকিৎসাধীন এক আত্মীয়কে হাসপাতালে দেখতে এসেছেন। একাধিক রিকশাচালক এবং দোকানির সঙ্গে কথা বললেও তারা চিনতে পারেননি। ভাষাসৈনিকের দেওয়া সড়ক কেউই চিনতে না পারা হতাশার বলে মনে করেন তিনি।

একসময় সড়কটির নাম ধানমন্ডি ৭ নম্বর সড়ক থাকলেও বর্তমান সিটি করপোরেশন অনুমোদিত নাম ‘ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সড়ক’। ধানমন্ডি মাইতুল জান্নাত জামে সমজিদ ধরে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড হয়ে সালাম’স কিচেনের সামনে পর্যন্ত সড়কটির বিস্তৃত। ভাষাসৈনিকের নামে সড়কটি নামকরণ করলেও পরিচিত হয়ে ওঠেনি। ৭ নম্বর সড়ক নামেই সবাই চিনে।

ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের সামনে এই ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের ম্যুরাল রয়েছে। ঠিক পাশে ছোট আরও একটি ম্যুরাল দেখা যায়। জানা যায় ঢাকা, সিটি করপোরেশন ও এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের সৌজন্যে ২০১০ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ করেন শিল্পী হাফিজ উদ্দিন বাবু। ম্যুরালটি ঘিরেও অযত্ন-অবহেলা দেখা গেছে।

ম্যুরালের সামনে গাড়ি, রিকশার জটলা থাকায় ভালোভাবে দেখা যায় না। মুরালের পাদদেশে বসে গল্প মেতে উঠতে দেখা গেছে অনেককেই। ম্যুরালের নামফলক হয়ে পড়েছে বিবর্ণ। কিছু একটা লেখা আছে বোঝা গেলেও রঙ না থাকায় সাদা বর্ণ ধারণ করেছে।

ভাষাসৈনিকেন নামে দেওয়া সড়কটি কতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা জানতে ঢাকা মেইল একটি জরিপ চালায়। জরিপে অংশ নেওয়া ১০ জনের মধ্যে দুজন সড়কটির নাম ভাষাসৈনিকের নামে হওয়ার ব্যাপারে অবগত। অন্যদিকে আটজন জানেন ‘৭ নম্বর সড়ক’ হিসেবে। অর্থাৎ শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষের কাছে নামটি পরিচিত নয়। আশপাশের দোকান এবং প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডেও সড়কটির নাম ৭ নম্বর সড়ক লেখা দেখা গেছে। একমাত্র ম্যুরালের মাধ্যমেই সড়টির নাম পরিবর্তন নিয়ে আসা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

Vasa2

তবিবুর রহমান নামে এক পথচারী বলেন, ‘নাম আসলে কিছূই না। নামে কিই বা আসে যায়। আপনার (প্রতিবেদক) ভাষ্যমতে সড়কটি ভাষাশহীদের নামে হয়ে থাকে, তাহলে নতুন নামেই ডাকা উচিত। তবে তা যেন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যায়। এর আগে মানুষ নামটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ভালোবাসা, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্পর্কে জানানো।’

রহিম গত চার বছর ধরে রিকশা চালান ধানমন্ডি এলাকায়। তার ভাষ্য মতে, যাত্রীরা যা শেখায় আমরা তাই শিখি। আপনার (প্রতিবেদক) মতো কেউই নতুন নাম (ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সড়ক) বলে রিকশায় উঠে বলেনি। তবে রাস্তার মাথায় একটি মূর্তি (ম্যুরাল) আমিও দেখেছি।

একাধিক দোকানি এবং স্থানীয়দের ভাষ্যও অনেকটা এমনই। ফজলে রাব্বি নামে একজন বলেন, ‘নতুন কিংবা পুরান নাম ব্যবহার নিয়ে কিছু আসে যায় না। কারণ, যদি বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হতো সিটি করপোরেশন থেকে নির্দেশনা দেওয়ার কথা। এ যাবৎ এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’

ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কের নামকরণ যেভাবে

দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসৈনিকদের নামে রাজধানীর ১১টি সড়ক রয়েছে। যার নামকরণ করা হয় অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের আমলে। ১১টি সড়কের মধ্যে ধানমন্ডিতেই ভাষাসৈনিকদের নামে সড়ক রয়েছে ১০টি। আর মিরপুর-১ নম্বরে রয়েছে একটি।

ভাষাসৈনিকদের নামে সড়কের নামকরণে একটি উপ-কমিটি করেছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। নথি সূত্রে জানা যায়, উপ-কমিটির নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন রাস্তা, অবকাঠামো এবং স্থাপনার নামকরণ উপ-কমিটি।’ যাদের হাত ধরেই সড়কগুলোর নামে পরিবর্তন আসে।

নামে পরিবর্তন আসা সড়কগুলো হলো ধানমন্ডির ৯ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব সড়ক, ৮ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সড়ক, ৭ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন সড়ক, ৬ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সড়ক, ৫ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সড়ক, ৪ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক অলি আহাদ সড়ক, ৩ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক, ১ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক, ১৫ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সড়ক, ৯/এ নম্বর সড়ককে ভাষাসৈনিক তোয়াহা সড়ক ও মিরপুর টেকনিক্যাল কলেজের মোড় থেকে মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত সড়ককে ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কালাম সড়ক হিসেবে নামকরণের প্রস্তাব দেয়।

Vasa3

পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১১তম সাধারণ সভায় এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ হয়ে ডিএসসিসি এবং ডিএনসিসি নামে পৃথক দুটি সংস্থা হয়। তখন ডিএনসিসির অধীনে চলে যায় প্রিন্সিপাল আবুল কালাম সড়ক। বাকি সড়কগুলো ডিএসসিসির অধীনে রয়েছে।

কোনো সড়কই পরিচিতি পায়নি পরিবর্তিত নামে। অযত্ন অবহেলায় দেখা গেছে নামফলক নিয়েও। কোথাও গড়ে উঠেছে চায়ের দোকান। কোথাও কোথাও রঙিন দেয়ালের সঙ্গে লাগানো সাদা মার্বেল পাথরে লেখা ভাষাসৈনিকের নামফলকটি দেখে বোঝা যায় না। আবার কয়েকটি নামফলকের ওপর সারা বছর থাকে পোস্টার সাঁটানো। প্রায় প্রতিটি সড়কের ফলকের চিত্র একই।

ডিএইচডি/জেবি


ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর