শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

আফতাবনগরের বদ্ধ জলাশয়ে 'সাকার ফিশ' এলো কীভাবে?

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০২২, ১০:৫৮ এএম

শেয়ার করুন:

আফতাবনগরের বদ্ধ জলাশয়ে 'সাকার ফিশ' এলো কীভাবে?
ছবি ঢাকা মেইল

বুধবার সকাল ৭টা। আফতাবনগরের ভেতরে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছ বিক্রির জন্য তুলছিলেন দুই ভাই আব্দুল হামিদ ও আব্দুস সামাদ। কিন্তু জাল টেনে যখন কিনারায় নিয়ে যান তখন দেখা মেলে কিছু সাকার ফিসের। জালে রুই, কার্প, তেলাপিয়ার সঙ্গে উঠে আসে এসব ‘সাকার ফিশ’। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে জলাশয়ে প্রাত:রাশ ভ্রমণ শেষে গোসল করা লোকজনকে। সবাই উৎসুক হয়ে দেখেন বিষয়টি। আর নানামুখী আলোচনা শুরু করেন। চারপাশ ঘেরা পরিবেশে এমন ভয়ঙ্কর প্রজাতির মাছ এলো কোথা থেকে তা নিয়ে আলোচনা করেন তারা।

আফতাবনগরের ভেতরে চারপাশ পাকা রাস্তা, বালু ভরাট করে প্লট তৈরি করা হয়েছে। যে জলাশয় থেকে সাকার ফিস পাওয়া গেলো তার আশপাশে কোনো খাল, নদী বা অন্য পুকুরও নেই। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য জানালেন মাছ চাষি দুই ভাই। তারা জানালেন গত ছয় মাস ধরেই এই মাছ জালে উঠে আসছে একটি দুটি করে।


বিজ্ঞাপন


'সাকার মাউথ ক্যাটফিস' যা সাকার ফিশ নামেই অধিক পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। অ্যাকুরিয়ামে চাষযোগ্য বিদেশি প্রজাতির এই ক্ষতিকর সাকার ফিস এখন হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন নদনদী, হাওর ও জলাশয়ে। বাদ যাচ্ছে না চাষের জমিতেও। চাষের জমিতে এই মাছ পাওয়া গেলে ওই মাছ চাষি সর্বস্বান্ত হয়ে যাবেন সেই আরও আতঙ্কের। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীতে জাল টানলেই অসংখ্য সাকার ফিস উঠে আসে। ফলে যারা এই নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতো তাদেরও কষ্টের অন্ত নেই।

আরও পড়ুন: সাকার ফিস ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সব নদীতে

চলতি বছরই উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র এবং বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী অবৈধভাবে পেতে রাখা জাল জব্দ করতে গিয়ে ‘সাকার ফিশ’ পাওয়া যায়। তা দেখে উদ্বেগ ছড়ায় মৎস্য গবেষকদের মধ্যেও। এখন যেখানে সেখানে ভয়ঙ্কর এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে, যা আতঙ্কের।


বিজ্ঞাপন


আফতাবনগরের বদ্ধ জলাশয়ে সাকার ধরা পরার পর আব্দুল হামিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, এই মাছটা শুনছি সব মাছ খাইয়া ফেলে। এইখানে কীভাবে আইলো বলতে পারি না। আমাদের ধারণা কেউ শত্রুতা করে ফেলতে পারে।

আরেক ভাই আব্দুস সামাদ ঢাকা মেইলকে বলেন, গত ছয় মাসে যতোদিন মাছ ধরেছি প্রতিদিনই এক বা দুটি করে জালে উঠছে এই মাছ। ৪ লাখ টাকার মাছে আমি বিক্রি করছি আড়াই লাখ টাকা। বাকি মাছ এখন একেবারেই উঠে না। আমরা শুনছি এই সাকার থাকলে বাকি মাছ খেয়ে ফেলে এখন সেটি বুঝতেছি। নয়তো এতো তাড়াতাড়ি আমাদের এখানে মাছ কমার কথা না।

কথাগুলো বলার সময় অনেকটা কেঁদেই ফেলেন সামাদ। তিনি বলেন, ‘এই মাছ যদি এতো ক্ষতিকর হয়, তয় কেউ কেন ব্যবস্থা নেয় না। আমাদের ইচ্ছা করে কেউ ক্ষতি করছে।’ বলেন, যেদিন থেকে এই মাছ পাচ্ছি মেরে ফেলছি।

sakar-3

আফতাবনগরের এই জলাশয়ে প্রায়ই গোসল করেন আমজাদ। এই মাছ দেখে অনেকটা চমকেই উঠেন তিনি। আমজাদ বলেন, আগে কয়েকবার খবরে দেখেছি বুড়িগঙ্গায় পাচ্ছে এই মাছ। এটি নাকি অ্যাকুরিয়ামে থাকে। আজ নিজ চোখে দেখলাম। কেমন কালো ডোরাকাটা। এখানে এই মাছ কীভাবে এলো সেটি বড় প্রশ্ন।

জলাশয়ে আসা সুজন, আব্দুর রহমানসহ উপস্থিত অনেকেই বিষয়টি বেশ আলোচনা করেন। সবার মুখেই একই কথা এই মাছ এখনো এলো কীভাবে?

হঠাৎ দেশের নদী ও পুকুরগুলোতে সাকার ফিসের উপস্থিতি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। মৎস গবেষকরা মনে করছেন, করোনাকালীন অ্যাকুরিয়াম ফিস বিক্রির দোকানগুলো কেউ কেউ হয়তো ড্রেনে ছেড়েছিল। পরে সেগুলো ধীরে ধীরে বুড়িগঙ্গা নদীতে চলে গেছে। এটাও একটা কারণ হতে পারে। এছাড়াও আমাদের দেশে যারা বিদেশি আছেন তারা যখন বিদেশ চলে যান তারাও ড্রেনে সেই মাছ ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারেন।

ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে জানা গেছে, দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে বিধায় উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবৃদ্ধি ও প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। মাছটি দ্রুত বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম বলে জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লে পাড়ে ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরি করে তা ধ্বংস করে। দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু ভক্ষণ করে মাছের বংশ বিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। জলাশয়ের তলার শ্যাওলা ও জৈব আবর্জনা খায় বিধায় জলজ পরিবেশের সহনশীল খাদ্যশৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

চলতি বছরই উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র এবং বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী অবৈধভাবে পেতে রাখা জাল জব্দ করতে গিয়ে ‘সাকার ফিশ’ পাওয়া যায়। তা দেখে উদ্বেগ ছড়ায় মৎস্য গবেষকদের মধ্যেও। এখন যেখানে সেখানে ভয়ঙ্কর এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে, যা আতঙ্কের।

এসব বিষয়ে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক বলেছেন, সাকার ফিশ কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশে আসছে। এটা নিষিদ্ধের জন্যও গেজেট হচ্ছে। সেটার যে প্রক্রিয়া লাগে সেটি আমরা করছি। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পিরানহা ও আফ্রিকান মাগুর নিষিদ্ধ করে গেজেট হয়েছে। এটির বিষয়ে গভীরভাবেই চিন্তা করে এগোনো হচ্ছে।

sakar fish-2

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরখানেক আগে সাকার ফিসের বিষয়ে করণীয় কী হতে পারে তা জানতে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস অধিদফতর থেকে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেই চিঠি পাওয়ার পর করণীয় কী তা জানিয়ে ইতোমধ্যে একটি রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট পাওয়ার পর কয়েকটি মিটিং হয়। মিটিংগুলোতে বেশ কিছু সুপারিশ ওঠে এসেছে। এখন সেই সুপারিশগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কাজ করছে মৎস অধিদফতর।

আরও পড়ুন: সাকার ফিশের কবলে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা

বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ এর আগে ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিস বৃদ্ধির বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। এজন্য আমরা স্যাম্পল সংগ্রহ করেছি। আর এই স্যাম্পল সংগ্রহের কাজটি করা ৪ থেকে ৫ মাস হয়ে গেছে। এটা নিয়ে আমাদের কাজ চলছে।

মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এই মাছ নির্মূলে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। এই মাছ পাওয়া মাত্র মেরে ফেলতে হবে। পাশাপাশি যদি বন্ধ্যা কিছু মাছ ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে তবে তাদের বংশ বাড়বে না। এছাড়াও ইঁদুর নিধনের মতো যদি অভিযান করা যায় তবে নির্মূল করা সম্ভব।  এই মাছ খাওয়া যাবে কি যাবে না তা নিয়ে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা করছে। এজন্য ঢাকার বুড়িগঙ্গা, ময়মনসিংহের একটি নদী ও চাঁদপুরের একটি নদী থেকে এ মাছের স্যাম্পল সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করেছেন তারা।

ডব্লিউএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর