শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ডে কেন বারবার আনারকলির নাম?

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০৪ আগস্ট ২০২২, ০২:২৫ পিএম

শেয়ার করুন:

‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ডে কেন বারবার আনারকলির নাম?

আলোচিত কূটনীতিক ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি কনসাল জেনারেল কাজী আনারকলিকে নিয়ে তোলপাড় চলছে সর্বত্র। বিশেষ করে কূটনৈতিক অঙ্গনের বাতাসে ভাসছে তার অতীতের বিতর্কিত নানা খবর। সবশেষ জাকার্তার বাসায় মাদক রাখাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ বেশ পুরানো। এর আগের একাধিক কর্মস্থলে এমন নানা বিতর্কে জড়ালেও তার বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলছেন, আগের অপরাধের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি আনারকলির বিরুদ্ধে। যে কারণেই অনেকটা ‘বেপরোয়া’ হয়ে ওঠেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


আর সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শুরুর দিকেই ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কোনো অসদাচরণ করলে গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব।

আগেও বিতর্কে জড়িয়েছেন আনারকলি 
গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ জাকার্তায় আনারকলির বাসায় গত মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ অভিযান চালায় ইন্দোনেশিয়া সরকারের মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ওই বাসা থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়।

ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনীতিক আনারকলি দায়মুক্তির আওতাধীন ছিলেন। তাই তাকে গ্রেফতার না করে দূতাবাসের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি জানার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাৎক্ষণিক তাকে দেশে ফেরার আদেশ জারি করা হয়।

তবে এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন কূটনীতিক কাজী আনারকলির বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছিলো। দীর্ঘদিন ধরে তার গৃহকর্মী নিখোঁজ ছিলেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এ খবর গণমাধ্যমে আসে।


বিজ্ঞাপন


এই ঘটনার মধ্যে ডেপুটি কনসাল জেনারেল কাজী আনারকলিকে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার হিসেবে বদলি করা হয়।

বাসায় নিষিদ্ধ মাদক মারিজুয়ানা রাখার অভিযোগে জাকার্তা থেকে প্রত্যাহার হওয়া উপ-রাষ্ট্রদূত কাজী আনারকলির বয়ফ্রেন্ড নাইজেরিয়ান ব্যবসায়ী উইলিয়াম ইরোমিসেলি বেনেডিক্ট ওসিগবেমের প্রতি সন্দেহের আঙ্গুলি রেখেই তদন্ত নেমেছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আনারকলির ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি উইলিয়ামের সঙ্গে সম্পর্কের পর থেকেই পাল্টাতে থাকেন ওই মেধাবী কূটনীতিক।

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ২০১৭ সালে তার গৃহকর্মী শাব্বির স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আনারকলির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। যাতে দাবি করেন আমেরিকার ভিসার জন্য সে বিপুল অর্থ আনারকলিকে দিয়েছে। সেখানকার আইনে এটি মানব পাচারের অভিযোগ। তাই এই অভিযোগ নিয়ে নড়েচড়ে বসে তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।

anarkoli

সে সময় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনারকলিকে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে আমেরিকা থেকে সরিয়ে নেয় ও দ্রুত বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখনও কাজী আনারকলির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানা গেছে। 

এদিকে নাইজেরিয়ান নাগরিক উইলিয়ামের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জাকার্তার মাদককাণ্ডের পর আবার আলোচনায় এসেছে আনারকলির সাবেক গৃহকর্মী সাব্বির। এই নাইজেরিয়ানের কারণেই গৃহকর্মী সাব্বির পালিয়ে ছিলেন বলেও গুঞ্জন আছে।

১৯৯৩ সালের ২৫শে মে জন্ম নেওয়া উইলয়ামের আদি নিবাস লাগোসে। তিনি উইলিয়াম নাইজেরিয়ার লাগোসের একটি রেজিস্টার্ড কোম্পানির পরিচালক।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আনারকলি ২০০১-২০০৩ সালে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (রাষ্ট্রাচার ভ্রমণ) পদে ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন আনারকলি। সে সময় স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে পড়তে যান তিনি। পড়াশোনা শেষে তাকে হংকংয়ে ভাইস কনসাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সেখানে আনারকলি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে উপ-দূতাবাসেই হাতাহাতি, মারামারির ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ আছে। পরবর্তীতে আনারকলিকে দায়মুক্তি দিয়ে রোমে পোস্টিং দেওয়া হয়। অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে শাস্তি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় বলে জানা গেছে। 

এদিকে ২০১২ সালে দেশে ফেরার পর চার বছর মন্ত্রণালয়ে ছিলেন আনারকলি। সে সময় আনারকলির বিরুদ্ধে সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অযথা হয়রানি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। এই অবস্থার পরও ২০১৬ সালে কাজী আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যাঞ্জেলেসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

যা বলছে মন্ত্রণালয় 
ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান কাজী আনারকলিকে ঢাকায় প্রত্যাহার করে আনার ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ও বিব্রতকর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে এই কূটনীতিকের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন ‘পররাষ্ট্র ক্যাডারের যে হাই স্ট্যান্ডার্ড, এটার সাথে আমরা কখনোই কমপ্রোমাইজ করব না। তদন্তে যদি সে দোষী সাব্যস্ত হয়, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এ বিষয়ে এটুকু বলতে পারি।’

আর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এমন কর্মকাণ্ডকে ব্যক্তিগত স্খলন হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তদন্ত শেষে দোষী হলে আনারকলির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবেও জানিয়েছেন তিনি। 

তদন্ত কমিটির মুখোমুখি আনারকলি 
তথ্য বলছে, জাকার্তা থেকে ফেরানোর পরপরই কাজী আনারকলি বিদেশে যাওয়ার ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাসায় মাদক রাখার বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছুটি বাতিল করেছে। আজ (বৃহস্পতিবার) তাকে তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হওয়ার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামসের নেতৃত্বে ঘটনাটি তদন্ত হচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনকে টেলিফোন করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। 

জানা গেছে, কাজী আনারকলির এবারের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর প্রকাশিত হওয়ায় টনক নড়েছে মন্ত্রণালয়ের। তবে এ জন্য তার বিরুদ্ধে নিতে জাকার্তা থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে মন্ত্রণালয়।

যা বলছেন সাবেক কূটনীতিক
কাজী আনারকলির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, যেহেতু তদন্ত হচ্ছে তাই আগেই কূটনীতিকের বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। দেখি তারা কী তথ্য পায়, কী ব্যবস্থা নেয়। তবে এমন কর্মকাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তি অবশ্যই ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করতে হবে। 

তদন্তে দোষী হলে কি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে সব কিছু অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী হবে। হতে পারে প্রমোশন বন্ধ করা। আবার অপরাধ গুরুতর হলে চাকরিচ্যুতিরও উদাহরণ আছে।

বিইউ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর