বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সাকার ফিস ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সব নদীতে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৩ আগস্ট ২০২২, ১১:০৬ এএম

শেয়ার করুন:

সাকার ফিস ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সব নদীতে
বুড়িগঙ্গায় জাল ফেলার পর জেলের জালে বিপুল সাকার ফিস | ছবি: সংগৃহীত

শাহজাহান আলী। কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকার বাসিন্দা তিনি। দুই যুগ আগেও নিয়মিত মাছ ধরেছেন বুড়িগঙ্গা নদীতে। ওই সময় বুড়িগঙ্গা থেকে শিকার করা মাছ বিক্রি করেই চলতো তার সংসার। তিনি এখনো খেই জালে মাছ শিকার করেন। তবে এখন শিকার করা মাছে সংসার চালাতে না পারায় অন্য কাজও করেন বাকি সময়। 

শাহজাহান ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, বুড়িগঙ্গায় এখন দেশি মাছ কমে গেছে। ইদানিং মাথা মোটা, মুখ বড় ও খয়েরী গায়ের মাছ বেশি মিলছে (সাকার ফিস)। এই মাছ খাওয়া যায় না। ফলে ধরলেই নদীতে আবার ফেলে দিতে হয়। আগে বর্ষায় এক ঘণ্টা মাছ ধরলে যা পাওয়া যেত এখন চার ঘণ্টায়ও তা পাওয়া যায় না। তিনি মনে করেন, দেশীয় মাছ কমে গেছে। 


বিজ্ঞাপন


সংগ্রহকৃত সাকার ফিসের স্যাম্পলগুলোতেও যদি ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি মেলে তবে বিষয়টি উদ্বেগের মনে করছেন তারা। তখন এই মাছ মানুষ এমনকি মাছেরও খাবার হিসেবে ব্যবহার করা মারাত্মক ক্ষতিকর হবে।  

শুধু শাহজাহানের জালেই নয়, বুড়িগঙ্গায় যারাই জাল ফেলছেন সবার জালে ধরা পড়ছে সাকার ফিস। এই মাছ খাওয়া যায় না বলে বেশির ভাগ জেলে সেগুলো আবারও ছেড়ে দিচ্ছেন। গত দেড় বছর এভাবেই মাছ ধরা পড়ছে সাকার ফিস। তবে এখন পরিমাণে এত বেশি যে বুড়িগঙ্গায় দেশীয় মাছের দেখা মেলাই ভার। 

বছরখানেক আগে বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিস পাওয়ার ভিডিও করে তা সামাজিক মাধ্যমে ছেড়েছিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের কনটেন্ট ক্রিয়েটর মামুন সোহাগ। তিনি বলেন, ওই সময় সব জেলের জালেই সাকার ফিস উঠেছিল। এখনকার অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। প্রায় সময় জেলেরা ফোন করেন অভিযোগ করেন। এটি মৎস অধিদফতরের দেখার বিষয়। 

যেহেতু তিনটি স্যাম্পল দিয়ে একটি গবেষণার ফলাফলে আসা অসম্ভব তাই তারা সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, রবিশাল, সিলেট ও মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন নদী থেকে সাকার ফিসের স্যাম্পল সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন এবং গবেষণাও চলছে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাকার ফিস এখন শুধু বুড়িগঙ্গায় নয় দেশের সব নদীতে কম বেশি মিলছে। ফলে এ মাছ দেশীয় মাছের খাবার খেয়ে ফেলছে। এছাড়াও এদের বংশ দ্রুত বৃদ্ধির ফলে দেশীয় মাছের থাকার জায়গাগুলোও দখল করে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় মাছের খাবার ও জায়গা সংকট হয়ে বিপন্নের দিকে এগোতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

sakar fish
দেশের নদীগুলোতে মিলছে বড় বড় সাইজের সাকার ফিস

কথা হচ্ছিল মানিকগঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রুবেল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, আগে নদীতে এই মাছ মেলেনি। কিন্তু সম্প্রতি বেশি হারে ধরা পড়ছে। প্রথম দিকে মাছটি ধরা পড়লে অনেকে সেটিকে নতুন মাছ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু বেশি হারে ধরা পড়ায় এখন অনেকে শঙ্কিত। এই মাছগুলো প্রতিকূল অবস্থাতেও টিকে থাকতে পারে। নোংরা ও কম অক্সিজেনযুক্ত দূষিত পানিতেও এরা বেশি বাচ্চা দিতে সক্ষম। এই মাছ সকলে খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে বাড়তো না। খাবার হিসেবে না খাওয়ার ফলেই বেশি বাড়ছে। 

মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এই মাছ নির্মূলে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। সব মিলে পুরো মাছ নির্মূলে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এই মাছ এখন দেশের সব নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মাছ পাওয়া মাত্র মেরে ফেলতে হবে।

সাতক্ষীরা সদরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখান প্রতিদিন ছোট নদী পুকুরে মিলছে সাকার ফিস। শুধু এই জেলায় নয় ময়মনসিংহের ব্রাহ্মপুত্র ছাড়া জেলাটির ছোট নদী এমনকি পুকুরেও এই সাকার ফিস মিলছে বলে জানালেন জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেন, এখন কম বেশি ময়মনসিংহের ছোট নদী ও পুকুরে এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটকে জানানো হয়েছে। তারা স্যাম্পল নিয়ে গেছেন। রংপুরের পীরগাছায় গত এক বছরে বেশ কয়েক দফা সাইজে বড় সাকার ফিস জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল বলে জানালেন ফরহাদুজ্জামান ফারুক। একই চিত্র দেশের অন্য নদীগুলোতেও। 

জনমনে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে, সাকার ফিস নদীর সব মাছ খেয়ে ফেলে। তবে এটা ঠিক না বলছেন মৎস গবেষকরা। তারা বলছেন, এসব মাছ একুরিয়ামে রাখা হয়, কারণ সেটিতে শ্যাওলা জমলে সে এগুলো খেয়ে পরিষ্কার করে। এই মাছ ময়লা খেয়ে বেঁচে থাকে। নদীতে জমে থাকা ময়লাই তার খাবার। তাই অন্য মাছ খেয়ে সাবাড় করে ফেলছে লোকজনের এসব কথা ঠিক না। তবে এই মাছ দুটি কাজ করছে। একটি নদীতে অন্য মাছের জায়গা দখল করছে পাশাপাশি নদীতে থাকা অন্য মাছের প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে ফেলছে। এতে দেশীয় মাছের খাবার সংকট হতে পারো। যদি তারা দেশীয় মাছের তুলনায় বেড়ে যায় আর এটাই এখন এ মাছকে নিয়ে যতো শঙ্কা। এই মাছ তলদেশের খাবার খায়। মাছটি কেঁচো ও পোকা মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। সুতরাং সে মাছকে শিকার করে না।

আগে নদীতে এই মাছ মেলেনি। কিন্তু সম্প্রতি বেশি হারে ধরা পড়ছে। প্রথম দিকে মাছটি ধরা পড়লে অনেকে সেটিকে নতুন মাছ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু বেশি হারে ধরা পড়ায় এখন অনেকে শঙ্কিত। এই মাছগুলো প্রতিকূল অবস্থাতেও টিকে থাকতে পারে। নোংরা ও কম অক্সিজেনযুক্ত দূষিত পানিতেও এরা বেশি বাচ্চা দিতে সক্ষম। এই মাছ সকলে খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে বাড়তো না। খাবার হিসেবে না খাওয়ার ফলেই বেশি বাড়ছে। 

তবে কি কারণে বাড়ছে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনো মৎস গবেষণা ও প্রাণী সম্পদ অধিদফতরের কাছে নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সাকার ফিস বৃদ্ধি কেন হচ্ছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই মৎস অধিদফতরের কাছে। তবে হঠাৎ দেশের নদী ও পুকুরগুলোতে এ মাছের উপস্থিতি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। 

মৎস গবেষকরা মনে করছেন, করোনাকালীন একুরিয়াম ফিস বিক্রির দোকানগুলো কেউ কেউ হয়তো ড্রেনে ছেড়েছিল। পরে সেগুলো ধীরে ধীরে বুড়িগঙ্গা নদীতে চলে গেছে। এটাও একটা কারণ হতে পারে। এছাড়াও আমাদের দেশে যারা বিদেশি আছেন তারা যখন বিদেশ চলে যান তারাও ড্রেনে সেই মাছ ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারেন। 

রংপুরের পীরগাছায় গত এক বছরে বেশ কয়েক দফা সাইজে বড় সাকার ফিস জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল বলে জানালেন ফরহাদুজ্জামান ফারুক। একই চিত্র দেশের অন্য নদীগুলোতেও

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরখানেক আগে এই ব্যাপারে করণীয় কি হতে পারে তা জানতে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস অধিদফতর থেকে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেই চিঠি পাওয়ার পর করণীয় কি তা জানিয়ে ইতোমধ্যে একটি রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট পাওয়ার পর কয়েকটি মিটিং হয়। মিটিংগুলোতে বেশ কিছু সুপারিশ ওঠে এসেছে। এখন সেই সুপারিশগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কাজ করছে মৎস অধিদফতর। 

sakar fish
দেশের জলাশয়গুলোতে মিলছে সাকার ফিস

কী ছিল সেই সুপারিশে
যদি নদী বা পুকুরে এই মাছ মেলে তবে ধরে মেরে ফেলতে হবে। সেটিকে জীবিত রাখা যাবে না। দ্বিতীয়ত সুপারিশটি ছিল যেহেতু উন্মুক্ত জলাশয়ের থাকা সাকার ফিস মাছগুলো নির্মূল করা একেবারে অসম্ভব। তাই এই মাছগুলোকে ধরে ধরে বন্ধ্যা করে আবার ছেড়ে দেওয়া। এতে তাদের বংশ বৃদ্ধি কমে যাবে। তখন আর এই মাছের সংখ্যা বাড়বে না।

বছরখানেক আগে এই ব্যাপারে করণীয় কি হতে পারে তা জানতে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস অধিদফতর থেকে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেই চিঠি পাওয়ার পর করণীয় কি তা জানিয়ে ইতোমধ্যে একটি রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট পাওয়ার পর কয়েকটি মিটিং হয়। মিটিংগুলোতে বেশ কিছু সুপারিশ ওঠে এসেছে

সাকার ফিসের নমুনায় মিলেছে ক্যাডমিয়াম
এই মাছ খাওয়া যাবে কি যাবে না তা নিয়ে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা করছে। এজন্য ঢাকার বুড়িগঙ্গা, ময়মনসিংহের একটি নদী ও চাঁদপুরের একটি নদী থেকে এ মাছের স্যাম্পল সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করেছেন তারা। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো তাদের গবেষণায় সংগ্রহকৃত মাছগুলোতে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ফলে মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট এখন বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে দেশের সব নদীতে ছড়িয়ে পড়া এই সাকার ফিস সংগ্রহ করে গবেষণা করছে। যেহেতু তিনটি স্যাম্পল দিয়ে একটি গবেষণার ফলাফলে আসা অসম্ভব তাই তারা সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, রবিশাল, সিলেট ও মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন নদী থেকে সাকার ফিসের স্যাম্পল সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন এবং গবেষণাও চলছে। এর ফলাফল কবে নাগাদ আসবে তা জানাতে পারেনি মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংগ্রহকৃত সাকার ফিসের স্যাম্পলগুলোতেও যদি ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি মেলে তবে বিষয়টি উদ্বেগের মনে করছেন তারা। তখন এই মাছ মানুষ এমনকি মাছেরও খাবার হিসেবে ব্যবহার করা মারাত্মক ক্ষতিকর হবে।  

শাহজাহান ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, বুড়িগঙ্গায় এখন দেশি মাছ কমে গেছে। ইদানিং মাথা মোটা, মুখ বড় ও খয়েরী গায়ের মাছ বেশি মিলছে (সাকার ফিস)। এই মাছ খাওয়া যায় না। ফলে ধরলেই নদীতে আবার ফেলে দিতে হয়। আগে বর্ষায় এক ঘণ্টা মাছ ধরলে যা পাওয়া যেত এখন চার ঘণ্টায়ও তা পাওয়া যায় না। তিনি মনে করেন, দেশীয় মাছ কমে গেছে

এই মাছ নির্মূলে করণীয় 
মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এই মাছ নির্মূলে সকলকে আন্তরিক হতে হবে। সব মিলে পুরো মাছ নির্মূলে ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এই মাছ এখন দেশের সব নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মাছ পাওয়া মাত্র মেরে ফেলতে হবে। পাশাপাশি যদি বন্ধ্যা কিছু মাছ ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে তবে তাদের বংশ বাড়বে না। এছাড়াও ঈদুর নিধনের মতো যদি অভিযান করা যায় তবে নির্মূল করা সম্ভব।  

বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, বুড়িগঙ্গায় সাকার ফিস বৃদ্ধির বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। এজন্য আমরা স্যাম্পল সংগ্রহ করেছি। আর এই স্যাম্পল সংগ্রহের কাজটি করা ৪ থেকে ৫ মাস হয়ে গেছে। এটা নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। 

এসআইকে/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর