বৃহস্পতিবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৬, ঢাকা

শাহজালালে যে আগুন এভিয়েশন খাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

শাহজালালে যে আগুন এভিয়েশন খাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে
শাহজালালে যে আগুন এভিয়েশন খাতের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে গত অক্টোবর মাসে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘটনাটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটলে কত বড় বিপর্যয় হতে পারে, তার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে এই অগ্নিকাণ্ড। একই সঙ্গে বিমানবন্দরে বিকল্প রানওয়ে থাকা কতটা জরুরি, তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এভিয়েশন খাতের সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্ট মহলের মত, এই ঘটনার পর দ্রুত সংস্কার ও আধুনিকায়ন না করা হলে ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যাবে।


বিজ্ঞাপন


ঘটনার পর সরকারি তদন্ত কমিটিগুলো তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এতে নাশকতা বা ইচ্ছাকৃত হামলার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আগুন লাগার ঘটনা যেভাবে ঘটে

বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকার একটি গুদাম থেকে প্রথমে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। ঘটনাটি ঘটে অক্টোবরের এক দুপুরে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গুদামগুলোতে। কার্গো শেডে থাকা দাহ্য ও বিপজ্জনক পণ্যের কারণে আগুন দ্রুত ভয়াবহ রূপ নেয়।

আগুন লাগার পর বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে সাময়িকভাবে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হয় এবং কয়েকটি ফ্লাইট অন্য বিমানবন্দরে সরিয়ে নেওয়া হয়। যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং বিমানবন্দর এলাকায় জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়।


বিজ্ঞাপন


খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, আনসার ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার ও নিরাপত্তা কার্যক্রমে অংশ নেন। কয়েক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় সন্ধ্যার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এই ঘটনায় কার্গো ভিলেজে সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পুড়ে যায়। এর মধ্যে তৈরি পোশাক, পোশাকের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং কুরিয়ার পণ্য ছিল। আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত কয়েকজন সদস্য আহত হন। তবে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

ঘটনার পর সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিতে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ, ফায়ার সার্ভিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি সিআইডি আলাদাভাবে ফরেনসিক তদন্ত পরিচালনা করে।

তদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কার্গো ভিলেজের একটি গুদামের ভেতরে বৈদ্যুতিক লাইনের ত্রুটি থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়। গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা এবং ফায়ার অ্যালার্ম ও স্প্রিংকলার সিস্টেমের ঘাটতি আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কার্গো ভিলেজ পরিচালনায় যে ধরনের অগ্নি–নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, তা পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। বিপজ্জনক ও দাহ্য পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বেড়ে যায়।

ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আধুনিক ফায়ার সেফটি সিস্টেম স্থাপন, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার নিয়মিত তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।

শাহজালালে নিরাপত্তা দায়িত্বে পরিবর্তন ও বাহিনীভিত্তিক মতবিরোধ

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বকে কেন্দ্র করে এপিবিএন ও বিমানবাহিনীর নিরাপত্তা সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে বৈঠক শেষে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দায়িত্ব এপিবিএন–কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে কিছু প্রশাসনিক মতানৈক্য ও দাপ্তরিক দাবি সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।

আগুনের পর নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ

অক্টোবরের অগ্নিকাণ্ডের পর ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অভিযোগ তোলে যে কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত এবং এটি দেশের রপ্তানি খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা দ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদান, গুদামগুলোর আধুনিকায়ন এবং উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপনের দাবি জানায়।

চলতি বছর এভিয়েশন খাতে আরও যে ঘটনা ঘটে

২০২৫ সালের শুরুতেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে একাধিক ঘটনার কারণে বছরটি আলোচনায় আসে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ঘন কুয়াশার কারণে কয়েক দিন বিমান ওঠানামা ব্যাহত হয়। ভোর ও সকালবেলায় দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে অবতরণ করতে পারেনি। নিরাপত্তার প্রয়োজনে কিছু ফ্লাইট চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে এবং ফ্লাইট সূচিতে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটে।

অগ্নিকাণ্ড যেভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে

২০২৫ সালে শাহজালালের কার্গো ভিলেজে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড দেশের এভিয়েশন খাতে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আগুনের কারণে কয়েক ঘণ্টা বিমান ওঠানামা বন্ধ রাখতে হয় এবং একাধিক আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বিকল্প বিমানবন্দরে সরিয়ে নিতে হয়। এতে এয়ারলাইন্সগুলোর সময়সূচি ব্যাহত হয়, পরিচালন ব্যয় বাড়ে এবং যাত্রীদের ভোগান্তি সৃষ্টি হয়।

এই ঘটনায় এয়ার কার্গো ব্যবস্থাপনায় বড় ধাক্কা লাগে। বিপুল পরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য ধ্বংস হওয়ায় রপ্তানিকারকেরা ক্ষতির মুখে পড়েন এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থায় প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের অগ্নি–নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা প্রকাশ পায়, যা আন্তর্জাতিক মান ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

অগ্নিকাণ্ডের ফলে বীমা ব্যয় ও নিরাপত্তা উন্নয়ন ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইন্স ও যাত্রীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের এভিয়েশন খাতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এমআইকে/এআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর