• মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড
• মামলায় সব আসামি অজ্ঞাত!
• মারামারিতে নেতৃত্ব দেন ছাত্রদল নেতা তরুণ ও সেলিম
• মামলা করতে পারছে না সাকিবের পরিবার
রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিবুল হাসান রানা হত্যার ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো মূল আসামিদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরায় হামলাকারীদের চেহারা স্পষ্ট থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তাদের খুঁজে পায়নি। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আসামিদের গ্রেফতার কার্যক্রম আটকে রাখা হয়েছে বলে নিহতের মা-বাবা অভিযোগ করলেও পুলিশের দাবি, আসামিরা সবাই গা ঢাকা দেওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
বিজ্ঞাপন
সাকিব হত্যা মামলার তদন্তকারী শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ দেখে প্রায় ৩০ জনের মতো জড়িত ছিল বলে স্বীকার করেছেন তিনি। তবে আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে তিনি নাকি ওয়াকিবহাল নন।
অন্যদিকে তেজগাঁও জোনের এডিসি ফজলুল করিম ঢাকা মেইলকে জানান, এ ঘটনায় সিসি ক্যামেরা দেখে মাত্র ১২ জনকে শনাক্ত করেছেন তারা। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তারও দাবি, সব আসামি পলাতক।
সেদিন যা ঘটেছিল
বিজ্ঞাপন
প্রত্যক্ষদর্শী ও কলেজটির একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে হোস্টেলের ছাদে কয়েকজন মাদক সেবন করছিলেন। সাকিবসহ তার বন্ধুরা বাধা দিলে হাতাহাতি হয়। পরে রাতে বিষয়টি নিয়ে সালিশ বৈঠক হয়। সেখানে ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোরশেদুল আলম তরুণ ও সেলিম মাদকসেবীদের পক্ষ নিলে ছাত্ররা ক্ষেপে যায় এবং ছাত্রদলের নেতাদের ধাওয়া দেন। সেই ধাওয়ার নেতৃত্ব দেন সাকিব।
ঘণ্টাখানেক পর ছাত্রদলের প্রায় ৩০ নেতাকর্মী হোস্টেলে প্রবেশ করে রুমে রুমে গিয়ে মারধর চালায়। শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরের গলিতে সাকিবকে একা পেয়ে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, পরে মালিবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিন পর ১০ ডিসেম্বর দুপুরে সাকিব মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সাকিবের ওপর বেশি ছিল ছাত্রদলের নেতাদের। সেজন্য তাকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বেশিরভাগ ছাত্র।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কলেজটির ছাত্রদলের আহ্বায়ক মোরশেদুল আলম তরুণের ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আসামিদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না: প্রশ্ন সাকিবের মায়ের
সাকিবের মা খালেদা আক্তার জানান, সিসি ফুটেজে ছেলে হত্যার ঘটনায় উপস্থিত ছাত্রদল নেতা তরুণ ও সেলিম স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। তবুও পুলিশ তাদের ধরছে না।
প্রশ্ন রেখে সাকিবের মা খালেদা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ছাত্রদল নেতা তরুণকে ভিডিওতে ক্যাপ ও জ্যাকেট পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট আকারে ভিডিওতে তাকে দেখা গেলেও পুলিশ নাকি খুঁজে পাচ্ছে না। তাকে গ্রেফতারও করছে না। তরুণ উল্টো সামাজিক মাধ্যমে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে তরুণ। এসব কি পুলিশ দেখে না।’
সাকিব হত্যায় যা বলছেন ছাত্রদল সভাপতি
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের একটি ক্লিপ ঘুরছে। সেখানে রাকিবকে বলতে শোনা যায়, ”আমি স্বীকার করছি তেজগাঁও কলেজে একটি সংঘর্ষের মাধ্যমে সাকিবকে হত্যা করা হয়েছে। ছাত্রদল সেই ছাত্র সংগঠন যে সংগঠন কোনদিন অপরাধীকে আড়াল করে না, কখনো অস্বীকার করে না। আমরা প্রেসরিলিজের মাধ্যমে প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছি, এ ঘটনায় যে বা যারা জড়িত থাকুক আপনাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। শুধু তাই নয়, আমরা নিজেরা প্রশাসনকে কল দিয়ে বলেছি অবশ্যই অপরাধীদের গ্রেফতার করতে হবে।’
মামলা ও কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা
সাকিব হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমদিকে তার মা খালেদা আক্তার মামলা করতে চাননি। তার মায়ের দাবি, ছেলেকে ময়নাতদন্ত করে কাটাছেঁড়া করা হবে বলে তিনি প্রথমদিকে মামলা করতে চাননি। পরে দেখেন তার ছেলেকে কাটাছেঁড়া করেই লাশ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন তিনি ছেলে হত্যাকাণ্ডের বিচার চান। এজন্য ঘটনার পর থেকে থানা পুলিশ ও আদালতের বারান্দা পর্যন্ত গেলেও এখনো মামলা করতে পারেননি।
ঢাকা মেইলকে খালেদা আক্তার বলেন, ‘আমরা দুই দিন আদালতে ও থানায় গিয়েছি কিন্তু পুলিশ মামলা দিচ্ছে না। পুলিশ বলছে, আগের মামলায় হবে (কলেজ কর্তৃপক্ষ পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে)। তার প্রশ্ন হলো, আগের মামলায় যদি হয় তাহলে আপনারা (পুলিশ) আসামি গ্রেফতার করছেন না কেন?’
সাকিবের মামা শহীদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মামলা তো হলো। কিন্তু পুলিশ তো আসামি ধরতেছে না।’
প্রবাসী বাবার স্বপ্নভঙ্গ
সাকিবের বাবা আলী হোসেন দেড় যুগ ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। ছেলের পড়াশোনা দেখে তিনি আশাবাদীও ছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় ঘাতকরা। সাকিবের বাবা আলী হোসেন মৃত্যুর খবর পেয়ে সেখান থেকে ছুটে আসেন দেশে।
আলী হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার জীবনে তো আর কিছু রইল না, একমাত্র ছেলের জন্য ১৮ বছর মালয়েশিয়ায় কাটিয়ে দিলাম, যা আয় করেছি সব টাকা তার পেছনে ব্যয় করেছি। স্বপ্ন ছিলে ছেলেকে উচ্চতর পড়ালেখা করাব। কিন্তু আমার স্বপ্ন পূরণ হলো না।’
আসামিদের গ্রেফতার না করার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে বলে তিনিও মনে করেন।
সাকিবের মা খালেদা আক্তার জানান, একমাত্র ছেলে হওয়ায় সাকিবকে খুব আদরে বড় করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ছেলেটাকে নিয়ে আমার আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল। ছেলে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? কেউ যদি বলত যে আমার এই ছেলেটা এই অপরাধ করেছে এজন্য তারা তাকে মেরে ফেলেছে তাহলে হয়তো মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তো এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না আমার ছেলের অপরাধ কী।?
নীরব ভূমিকায় ছিল কলেজ প্রশাসন!
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ৩০ জনের মতো নেতাকর্মী আচমকা প্রবেশ করে। কয়েক ঘণ্টা ধরে তারা হোস্টেল ক্যাম্পাসে ত্রাস চালায়। বিষয়টি হোস্টের সুপার, অধ্যক্ষ ও ম্যানেজিং কমিটির নেতাদের ছাড়াও পুলিশ প্রশাসনকে জানায় ছাত্ররা। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পাশাপাশি এ ঘটনায় হামলাকারীদের প্রত্যেকের ভিডিও হোস্টেল সিসি ক্যামেরায় ধারণ আছে, যা পুলিশ নিয়েও গেছে। কিন্তু ‘অজানা কারণে’ পুলিশ তাদের ধরছে না।
মামলার এজাহারে সব আসামি অজ্ঞাত!
সাকিব হত্যাকাণ্ডের পর হোস্টেল সুপার বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি সব আসামিকে অজ্ঞাত দেখিয়েছেন। অথচ ঘটনার সময় কারা কারা উপস্থিত ছিল তা সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট। কিন্তু কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি মামলায়।
অনেক শিক্ষার্থী বলেন, আসামিরা ছাত্রদলের নেতাকর্মী হওয়ার কারণে কলেজ প্রশাসন তাদের কারো নাম মামলার এজাহারে ইচ্ছে করেই উল্লেখ করেনি। এমন করে কলেজ প্রশাসন মূলত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আড়াল করতে চায়।
কলেজটির অধ্যক্ষ শামীমা ইয়াসমিন ঢাকা মেইলের কাছে দাবি করেছেন, তিনি ঘটনার দিন বিষয়টি জানতেনই না। পরদিন হোস্টেল সুপারের মাধ্যমে জেনেছেন।
মামলায় আসামি অজ্ঞাত কেন বিষয়টির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমরা শুরুর দিকে কে বা কারা ঘটিয়েছে তা জানতাম না। ফলে আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া ঘটনার রাতে হোস্টেল সুপার সেখানে ছিলেন না আর তিনি তো দেখেননি। ফলে কীভাবে কারা তাকে মেরেছে সেই নামগুলো মামলায় দেবেন! কারা কারা জড়িত আমরা এ বিষয়ে পুলিশকে যাবতীয় তথ্য দিয়েছি। তারা আসামিদের ধরার জন্য চেষ্টা করছেন।’
এমআইকে/এমআর

