আমদানি নিষিদ্ধ ই-সিগারেট পণ্যের বিস্তার এবং নিকোটিন পাউচ উৎপাদন কারখানার অনুমোদন জনস্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। দেশে ই-সিগারেট, ভেপ ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবে এসব পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে— এসব সিদ্ধান্ত জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর বনানীতে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল আয়োজিত ‘নিকোটিন, পাউচ ও ই-সিগারেট, বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব মতামত তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেল পরিচালিত এক গবেষণায় দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের ৩৬০টি এলাকা ও ৩২৬টি দোকান পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ই-সিগারেট বিক্রির সঙ্গে যুক্ত দোকানের ৭৫ শতাংশই ঢাকায় অবস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের নামে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের জন্য কারখানার অনুমোদন দেওয়া হলে দেশে তামাক আসক্তি, অসুস্থতা ও মৃত্যুহার আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। জনস্বার্থ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুরক্ষায় নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন বাতিল এবং ই-সিগারেটের অবৈধ আমদানি ও বিপণন বন্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান বিশেষজ্ঞরা।
তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ হেলাল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার সভাপতি অধ্যাপক ডা. অরূপরতন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মো. শফিকুল ইসলাম, আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম, গবেষক আমিনুল ইসলাম বকুল এবং ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ। টিসিআরসির প্রকল্প পরিচালক মো. বজলুর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্প কর্মকর্তা মো. জুলহাস আহমেদ।
গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধে মো. জুলহাস আহমেদ বলেন, ই-সিগারেটের বাজার স্পষ্টভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক। শনাক্ত বিক্রয়স্থানের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ঢাকায় অবস্থিত। রাজধানীতে শুধুমাত্র ই-সিগারেট ও সংশ্লিষ্ট ডিভাইস বিক্রির জন্য বিশেষায়িত দোকান রয়েছে ১৩৫টি। বিপরীতে ঢাকার বাইরে এ ধরনের দোকান মাত্র ১৯টি। এছাড়া ই-সিগারেট, ঘড়ি, চশমা, বেল্ট, মানিব্যাগ, কসমেটিকস ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্যের দোকানেও বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার বাইরে এসব দোকানে ই-সিগারেট বিক্রির উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে সীমিত। তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, ই-সিগারেট ক্রেতাদের প্রায় ৯৮ শতাংশই ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি তরুণ। ফল ও আইস ফ্লেভারেরই-লিকুইড বেশি বিক্রি হচ্ছে, যা তরুণদের লক্ষ্য করে বাজারজাতকরণের কৌশলকে স্পষ্ট করে।
নিকোটিন পাউচ বিষয়ে তিনি জানান, ঢাকা শহরের দোকানগুলোতে এ পণ্য বিক্রির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনলাইনে সীমিত কয়েকটি প্ল্যাটফর্মে এর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। নিকোটিন পাউচে থাকা নিকোটিন ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি এ পণ্য নিষিদ্ধের দাবি জানান। আপিলেট ডিভিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন দ্রুত বাতিল করা প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিজ্ঞাপন
অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ই-সিগারেট নিষিদ্ধে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জনস্বার্থে চাপ বাড়ানো জরুরি। আপিলেট ডিভিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিকোটিন পাউচও নিষিদ্ধ করতে হবে।
ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষা করে বেজা কর্তৃপক্ষ নিকোটিন পাউচ কারখানার অনুমোদন দিয়েছে, যা মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। এ অবৈধ অনুমোদনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
আমিনুল ইসলাম বকুল বলেন, ই-সিগারেট আমদানী নিষিদ্ধ হলেও নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা আরও স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো ভুয়া গবেষণা তথ্যের মাধ্যমে ক্ষতিকর পণ্য বাজারজাত করার চেষ্টা করে এবং রাজস্ব হারানোর ভয় দেখায়। তামাক কোম্পানির স্বার্থ নয়, সরকারের উচিত জনস্বার্থ রক্ষা করা।
শফিকুল ইসলাম বলেন, উৎপাদনের অনুমতি ছাড়াই ই-সিগারেট দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। নতুন তামাক পণ্য অনুমোদনের পরিবর্তে বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক ডা. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে মানুষ যখন সচেতন হচ্ছে, তখনই তামাক কোম্পানিগুলো নতুন পণ্য এনে কিশোর-তরুণদের লক্ষ্য করছে। মানুষের মস্তিষ্ক পরিপূর্ণভাবে গঠিত হতে ২৬ বছর সময় লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরিণত মস্তিষ্ক ধ্বংসের এই প্রচেষ্টা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
সভাপতির বক্তব্যে হেলাল আহমেদ বলেন, একদিকে সরকার তামাক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করছে, অন্যদিকে সরকারি একটি সংস্থাই নেশাজাত দ্রব্য উৎপাদনের অনুমোদন দিচ্ছে— এই দ্বিমুখী অবস্থান জনস্বার্থবিরোধী। ই-সিগারেট নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
সভায় বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এএইচ/এজে

