শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

গণভোট ও সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে যা বললেন সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

গণভোট ও সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে যা বললেন সিইসি

আসন্ন গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। এ সময় তিনি জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘যেকোনো ভয়ভীতি, প্রলোভন, প্রবঞ্চনা এবং সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে নিঃসংকোচে আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন।’

বুধবার (১১ ডিসেম্বর)  জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করে এসব কথা বলেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


১২ মিনিটের ভাষণে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন তিনি। একইসঙ্গে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার সকল আন্দোলনে যারা আহত, নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক সমবেদনা। আহতদের দ্রুত আরোগ্য এবং স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রার্থনা করছি।’

সিইসি বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমাদের অমোঘ শক্তি হচ্ছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ। জাতির প্রত্যাশাকে ধারণ করে আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রের ওপর জনগণের একচ্ছত্র মালিকানা নিশ্চিত করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল মালিকানা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানসম্মত নির্বাচনের অনুপস্থিতি প্রায়শই আমাদের ঐতিহ্য এবং সামষ্টিক প্রত্যাশাকে ম্লান করেছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। আমাদের ভাইবোন সন্তানদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে, একটি সুষ্ঠ ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান, যা জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে এবং বিশ্বদরবারে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা একই প্রত্যাশা ধারণ করেন এবং একই অঙ্গীকারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।’


বিজ্ঞাপন


দেশবাসীর উদ্দেশে ভোটের পথে কমিশনের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ভোট বিমুখ এবং বাদ পড়া প্রায় ৪৫ লাখ ভোটারকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং ২১ লক্ষাধিক মৃত ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নারী ভোটারদের যথাযথ অন্তর্ভুক্তির অভাবে পুরুষের সঙ্গে নারী ভোটারের ব্যবধান বেড়ে প্রায় ২৯ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। বাদ পড়া নারী ভোটারদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেই ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে।’

আইন সংশোধন করে ভোটার যোগ্যতার তারিখ প্রতিবছর পয়লা জানুয়ারির পরিবর্তে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত দিনে নির্ধারণ করার কথা বলেন তিনি।

এসব কাজ সম্পন্ন করার পর আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন ভোটারের তালিকা চূড়ান্ত করার কথা বলেন সিইসি।

এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭ হাজার ৯৪২ জন।

নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতা বাড়াতে বহুবিধ আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার শেষ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিতে যথাযথ পরিবর্তন সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব মূল্যায়ন ও অংশীজনের পরামর্শের ভিত্তিতে এসব সংস্কার করা হয়েছে। এই উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহযোগিতার জন্য আমি অন্তর্বর্তকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন সহ সকল অংশীজনদের জানাই আমার কৃতজ্ঞতা।’

‘অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ’ নির্বাচন

চার কারণে এবারের নির্বাচনকে ‘জাতির ইতিহাসে অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত সংস্কার প্রশ্নে সিদ্ধান্তের নির্বাচন এটি। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে যা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই নির্বাচন হচ্ছে সক্ষমতা প্রমাণ করে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অনন্য সুযোগ। তৃতীয়ত দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের পর দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে সৌহাদ্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার ধারা প্রবর্তনের দাবি রাখে এই নির্বাচন।’

চতুর্থ কারণ হিসেবে প্রবাসী ও কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের ভোটের আওতায় আনার কথা তুলে ধরে সিইসি বলেন, ‘প্রায় অকার্যকর পোস্টাল ভোট ব্যবস্থাকে পরিমার্জন করে এই নির্বাচনে একটি কার্যকরী রূপ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা তথা প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের প্রথমবারের মতো ভোটের আওতায় আনা হচ্ছে। একইভাবে প্রথমবারের মত ভোটের আওতায় আসছেন আইনি হেফাজতে থাকা ভোটারগণ। এ ছাড়াও নিজ নির্বাচনি এলাকার বাইরে কর্মরত সরকারি কর্মচারী এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে এবার ভোট দেবেন।’

উৎসবমুখর ভোটের অপেক্ষা

ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ভোট আপনার শুধু নাগরিক অধিকারই নয় বরং পবিত্র আমানত ও দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সচেতনভাবে আপনারা পালন করবেন এ আমার বিশ্বাস। যেকোনো ভয়ভীতি, প্রলোভন, প্রবঞ্চনা এবং সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে নিঃসংকোচে আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন। আপনাদের নিরাপদ ও উৎসবমুখর অংশগ্রহণকল্পে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও বাহিনী কাজ করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ম, গোত্র, গোষ্ঠী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে এই আনন্দ আয়োজনে অংশগ্রহণ করুন। পরিবারের প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও সন্তান সম্ভবা মা-সহ সকলকে নিয়ে ভোট দিতে আসুন। আমি আশা করি আপনাদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোটের অনুষ্ঠান উৎসবে রূপ নেবে।’

প্রবাসী ভোটারদের নিবন্ধন কার্যক্রম ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে ভোটদানের জন্য আপনারা নিবন্ধন করতে পারবেন। আপনারা এই সুযোগ গ্রহণ করে ভোটে অংশ নিন। দেশ গঠনে আপনাদের অধিকার বুঝে নিন।’

প্রবাসী ভোটারদের পাশাপাশি দেশের ভেতরে তিন ধরনের ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ করার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘প্রবাসী ভোটারগণের পাশাপাশি এই তিন ধরনের ভোটারগণ আগামীকাল থেকে শুরু করে আগামী ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপ এর মাধ্যমে এবং নির্ধারিত পদ্ধতিতে পোস্টাল ভোটের জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। ব্যক্তি ভোটার ও প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি আমার আহ্বান আসুন আমরা আমাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করি এবং ভোটে অংশ নেই।’

অসত্য তথ্যে কান দেবেন না

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা তথ্যের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে সিইসি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অসত্য তথ্য ও অপতথ্যের বিস্তার দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিপক্ষ দল ও প্রার্থীকে হেয় করার পাশাপাশি নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা আমাদের ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ণ করে এবং নির্বাচনকে কলুষিত করে।দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অনিয়ম রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ অসত্য এবং অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচারিত কোনো তথ্যে কান দিবেন না, গ্রহণ করবেন না। মনে রাখবেন অসত্য তথ্য শেয়ার করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

আচরণ বিধি মেনে চলুন 

নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থী এবং দলসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসুন আমরা আচরণবিধি মেনে একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিত করি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে ভোটারদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনই হোক আপনাদের লক্ষ্য।”

নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা নিরপেক্ষতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর কমিশনের অংশ হিসেবে আপনারা নির্ভয়ে সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। মনে রাখবেন, এ ব্যাপারে কোনো শিথিলতা বা গাফিলতি সহ্য করা হবে না।’

তফসিলের পর থেকে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীর সহায়তা কামনা করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ ভোটারদের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তা কামনা করছি। সকলের প্রতি আমার আহ্বান আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সফল করে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’

সংবাদকর্মী পর্যবেক্ষকদের ‍উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবাদ মাধ্যম ও পর্যবেক্ষক সংস্থার সহকর্মীদের ভূমিকা অপরিসীম। আপনারা স্বাধীনভাবে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে আপনাদের দায়িত্ব পালন করবেন এটি আমাদের প্রত্যাশা।’

তফসিল

ভোটগ্রহণ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬, বৃহস্পতিবার, সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, মনোনয়নপত্র বাছাই: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে ৪ জানুয়ারি ২০২৬, রিটার্নিং অফিসারের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের শেষ তারিখ: ১১ জানুয়ারি ২০২৬, কমিশনে দায়েরকৃত আপিল নিষ্পত্তি: ১২ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি ২০২৬, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ: ২০ জানুয়ারি ২০২৬, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্ধ: ২১ জানুয়ারি ২০২৬, নির্বাচনি প্রচারণা: ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৬, সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।

এমএইচএইচ/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর