বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা যে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে থেকে যাচ্ছে, এ বাস্তবতা তুলে ধরে ২৯ জুলাইকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ)।
বৃহসাপতিবার (১১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে নিসআ’র উদ্যোগে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন- ২০২৬ এর ইশতেহারে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা’ শীর্ষক বহুদলীয় বৈঠকে এ দাবি জানানো হয়।
বিজ্ঞাপন
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আমার বাংলাদেশ পাটি (এবি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বক্তারা বলেন, বিশ্বব্যাপী ৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশেও একই চিত্র। অথচ সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের পরও সড়ক পরিবহন খাতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলে শক্তিশালী হয়ে ওঠা পরিবহন সিন্ডিকেট আবারও সংগঠিত হয়ে খাতটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা আইন বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি, অপপ্রচার ও ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখছে বলেও অভিযোগ করেন বক্তারা।
সভায় জানানো হয়, গত তিন বছরে সরকারি হিসাবে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ২০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা থাকলেও ভুক্তভোগীদের মাত্র ১ শতাংশ এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। প্রচারণা না থাকায় অধিকাংশ মানুষ এই সুবিধা সম্পর্কে জানেন না।
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে বলে দাবি করা হয় বৈঠকে। বক্তারা বলেন, রাজধানীতে দুই লাখের মতো অটোরিকশা চলার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে তা ১৫ থেকে ২০ লাখে গিয়ে ঠেকেছে। মহাসড়কে ধীরগতির এসব যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও সভায় উঠে আসে। বলা হয়, আধুনিকায়নের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর হয়নি। ফলে এখনও হস্তচালিত সংকেত ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে পুরো নগরীর যান চলাচল।
একইভাবে বাস রুট রেশনালাইজেশন পরিকল্পনারও কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই। রুটের বিশৃঙ্খলা, মালিকদের রেষারেষি ও প্রতিযোগিতামূলক গতি থামানো যাচ্ছে না। বক্তাদের অভিযোগ, পরিবহন খাতে কার্যকর সুশাসন না থাকায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে না।
সভায় দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কথাও উঠে আসে। টিআইবি’র প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বিআরটিএ দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। লাইসেন্স, ফিটনেস, রুট পারমিটসহ সব জায়গায় ভোগান্তি, অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
বক্তারা বলেন, সড়ক অবকাঠামোয় নকশাগত ত্রুটি, ফুটপাত দখল, অনিয়ন্ত্রিত ক্রসিং, হাইওয়েতে অবৈধ স্থাপনা এবং সঠিক নজরদারির অভাব দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। পথচারী-বান্ধব শহর গড়ে না উঠলে এবং হাইওয়েতে নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত না করলে প্রাণহানি কমবে না।
দুর্ঘটনা-পরবর্তী অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, দেশের বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটে দুর্ঘটনার পরে, কারণ দ্রুত চিকিৎসা ও জরুরি সেবা পাওয়া যায় না। উন্নত দেশের মতো একটি সমন্বিত জরুরি ব্যবস্থাপনা না থাকায় দুর্ঘটনার পর অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু বাড়ছে।
সরকার, রাজনৈতিক দল, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা ছাড়া সড়ক নিরাপত্তার অর্জন স্থায়ী হবে না। জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে সড়ক নিরাপত্তাকে ঘোষণা, বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ, দিকনির্দেশনামূলক নীতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো-টলারেন্স নিশ্চিত করলেই এই খাতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব।
এএইচ/এআর

