ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একইদিনে ভোট এবং গণভোট। এ নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। তার আগে অপেক্ষা তফসিল ঘোষণার। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) এই কাজ সমাধা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জানা গেছে, এদিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন ভাষণ দেবেন। সেখানেই ঘোষণা করা হবে নির্বাচনের তফসিল।
বিজ্ঞাপন
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত রোববার দশম কমিশন সভায় ভোটের তফসিল চূড়ান্ত করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে সার্বিক অগ্রগতি তুলে ধরে নির্বাচন কমিশন।
তার আগে মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সিইসি। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দুপুরে ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তিনি। এরপর পরই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ রেকর্ড করবেন সিইসি।
তবে বুধবার যদি তফসিল ঘোষণা করা না হয়, বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাউসদ জানিয়েছেন, ‘তফসিল ঘোষণার জন্য ভাষণের সবকিছু চূড়ান্ত। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এদিন সন্ধ্যায় অথবা বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) তফসিল ঘোষণা করা হবে।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানান, ‘আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। তফসিল ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আসন বিন্যাস, আইন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যারা থাকবেন তাদের প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন বিষয়ে ২০টির মতো পরিপত্র জারি হবে। সেখানে মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি নিয়োগ, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইনশৃঙ্খলার সেল গঠন- এগুলোর ফরমেট রেডি রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরপর সেগুলো ধারাবাহিকভাবে আমরা জারি করব।’
প্রথমবারের মতো পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন প্রবাসীরা
দেশের ইতিহাসে একদিনে দুই ভোট আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো পোস্টাল ব্যালটে সংসদ নির্বাচন ও গণভোটে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন প্রবাসী বাংলদেশিরা।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, গত ১৯ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারীদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে, চলবে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যন্ত চলবে ভোটের কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের নিবন্ধন কার্যক্রম। তবে যারা ভোটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবেন, তাদের নিবন্ধন আরও কিছুদিন পরে শুরু হবে।
যত দল অংশ নিতে পারে ভোটে
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ নিবন্ধিত অর্ধশতাধিক দল অংশ নিতে পারবে। নিবন্ধন স্থগিত থাকায় আওয়ামী লীগের এ সুযোগ থাকছে না। অন্যদিকে অংশ নেওয়ার বিষয়ে এখনো পরিষ্কার করে কিছু জানায়নি জাতীয় পার্টি।
বর্তমানে ইসির নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৫টি। দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে আরও দুটি রাজনৈতিক দল এ নিবন্ধনের তালিকায় যুক্ত হবে। সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয় ২০০৮ সালে। তখন থেকে এ পর্যন্ত ৫৯টি দল নিবন্ধন পেয়েছে।
প্রথম সংসদ নির্বাচনে ১৪টি দল অংশ নেয়। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ দল, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি দল, চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে মাত্র আটটি দল অংশ নিয়েছিল। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি দল অংশ নেয়।
তফসিল ঘিরে দলগুলোর অবস্থান
তফসিল ঘোষণার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছে বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াত ইসলামী। বৈঠক শেষে সব দলই ভোটের পক্ষে, তবে বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে জামায়াত ও এনসিপির অসন্তোষ রয়েছে।
সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় আছি। অনিবার্য কোনো কারণ ছাড়া আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে যেতে চাই না।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা কোনো অনাস্থা নিয়ে আসিনি। জাতি মনে করছে নির্বাচনের তফসিল নিয়ে সময় পার হয়ে যাচ্ছিল, তাই আমরা এসেছি। ইসির উপর আমাদের আস্থা রয়েছে। এখন নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। আমরা সুনির্দিষ্ট ঘটনা তুলে ধরেছি। কোনো কর্মকর্তা অনিয়ম করলে আমরা তুলে ধরব, ইসি বলেছে ব্যবস্থা নেবে।
এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা বলেছি, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই তারা যাতে তফসিলের ঘোষণাটি দেয়। তফসিল এমন সময়ে দেওয়া হোক, যখন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে।
পোস্টাল ব্যালটে থাকছে না নৌকাসহ ৪ প্রতীক
আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটে থাকবে না নৌকাসহ চার প্রতীক। এমনটাই জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
জানা যায়, এবারের নির্বাচনে প্রতীকের তালিকায় ১১৯টি প্রতীক রাখা হয়েছে। তবে পোস্টাল ব্যালটে ১১৫টি প্রতীক থাকবে। নিবন্ধন স্থগিত থাকা আওয়ামী লীগ (নৌকা), সেই সঙ্গে নিবন্ধন বাতিল হওয়া ফ্রিডম পার্টি (কুড়াল), ঐকবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন (চাবি) ও পিডিপির (বাঘ) প্রতীকও থাকবে না পোস্টাল ব্যালটে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ‘চূড়ান্ত পোস্টাল ব্যালটে নিষিদ্ধ বা স্থগিত কোনো দলের প্রতীক থাকবে না।’
একদিনে দুই ভোটে বাড়বে বাজেট ও ভোটগ্রহণের সময়
একদিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হওয়ায় এবার বাজেট বাড়বে। অন্যদিকে ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত নির্বাচনগুলোয় ৮টা থেকে শুরু করে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হতো। এবার এক ঘণ্টা বাড়িয়ে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে শুরু করে বিকেল সাড়ে চারটা টানা ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
পদে থাকলে ভোটে অংশ নিতে পারবে না সরকারের উপদেষ্টারা
অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টারা পদে থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ জানান, ‘সরকারের উপদেষ্টারা পদে থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে পদত্যাগ করে অংশ নিতে হবে।’
দুই ভোট একসঙ্গে, চ্যালেঞ্জ দেখছে না ইসি
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলেও কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন নির্বাচন কশিনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, ‘আমরা ভোটের জন্য প্রস্তুত। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে বলে আর মনে করি না।’
তিনি জানান, নিবন্ধিত দলগুলো ভোটের জন্য প্রস্তুত। অংশ নেওয়াও তাদের অধিকার। ভোটের পরিবেশ তৈরি করতে কমিশন বদ্ধপরিকর। আমাদের নির্দেশনা একটাই- আইন-বিধি মেনে সবাইকে কাজ করতে হবে।
ভোট দেবেন প্রায় ১২ কোটি ৭৭ লাখ ভোটার
সবশেষ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ এবং মহিলা ভোটার ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩৪।
ভোটদানের জন্য কেন্দ্র চূড়ান্ত করা হয়েছে ৪২ হাজার ৭৬১টি। এতে মোট ভোট কক্ষ থাকবে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি। এরমধ্যে পুরুষদের জন্য ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩৭টি এবং মহিলাদের জন্য ১ লাখ ২৯ হাজার ৬০২টি। তবে দুই ভোট একসঙ্গে হওয়ায় গোপন কক্ষ (ভোট প্রদানের কক্ষ) বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে ইসি।
জানা যায়, সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে সরকার থেকে গণভোটের ঘোষণা আসায় অতিরিক্ত ব্যালট পেপার, অতিরিক্ত গোপন কক্ষ, বাজেট বৃদ্ধি— এমন আরও বেশ কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়েছে।
ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আইন-বিধি সংশোধন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক নিবন্ধন, অধিকাংশ ছাপার কাজ, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে ইসি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের সব বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকও শেষ হয়েছে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির। এখন তারা আলোচনা করছে নির্বাচনি বাজেট নিয়ে।
এমএইচএইচ/এএইচ

