মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নিকোটিন পাউচ কারখানার অনুমোদন বাতিলের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

DRU
সংবাদ সম্মেলন করছেন তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা। ছবি: ঢাকা মেইল

নিকোটিন পাউচ কারখানা স্থাপনের অনুমোদন বাতিলের দাবি জানিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা। তারা বলেছন, মহামান্য হাইকোর্টের আপিল বিভাগের স্পষ্ট নির্দেশনা উপেক্ষা করে বাংলাদেশে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এ পরিস্থিতিতে অবিলম্বে অনুমোদন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় বাংলাদেশ সেন্টার ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিসিজিডি), বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট, বাংলাদেশ টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যাডভোকেটস (বিটিসিএ) এবং পাবলিক হেলথ ল’ইয়ার্স নেটওয়ার্ক।


বিজ্ঞাপন


সংবাদ সম্মেলনে বিটিসিএর আহ্বায়ক ইকবাল মাসুদের সভাপতিত্বে ও ধোঁয়াবিহীন তামাক বিশেষজ্ঞ ফারহানা জামান লিজার সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন- কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু নাসের অনিক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মঈনুল হাসান সোহেল, উন্নয়ন সংস্কারক এ কে এম মাকসুদ, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী হেলাল আহমেদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ড. অনুপম হাসান, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি প্রফেসর ডাক্তার গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্য বিসিজিডির সদস্য সচিব বজলুর রহমান বলেন, ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের যে অনুমোদন বাংলাদেশে দেওয়া হয়েছে, তা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন। আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী দেশে নতুন কোনো তামাক কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া যাবে না, বরং বিদ্যমান তামাক কোম্পানিগুলোকে ধীরে ধীরে অন্য শিল্পে স্থানান্তরের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সেই রায়ের পরিপন্থী সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে বেজার মাধ্যমে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিকোটিন পাউচ বা ওরাল নিকোটিন পাউচ (ওএনপি) আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত সমালোচনার মুখে থাকা এক ধরনের উচ্চমাত্রার নেশা সৃষ্টিকারী তামাকজাত পণ্য। ছোট সাদা প্যাকেটের মতো এই পণ্যটি ঠোঁট ও মাড়ির মাঝখানে রেখে ব্যবহার করা হয় এবং মুখগহ্বরের মাধ্যমে নিকোটিন সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে। গবেষণায় প্রমাণিত-অনেক নিকোটিন পাউচে সিগারেটের তুলনায় বহু গুণ বেশি নিকোটিন থাকে এবং এই উচ্চমাত্রার নিকোটিন দ্রুত আসক্তি তৈরি করে, বিশেষ করে তরুণদের জন্য এটি ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করে।


বিজ্ঞাপন


এতে ব্যবহৃত কৃত্রিম স্বাদ, প্লাস্টিক সদৃশ সেলুলোজ, ফরমালডিহাইড, নিকেল, ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক মুখগহ্বর, দাঁত, মাড়ি, রক্তচাপ এবং হৃদরোগসহ নানা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই পণ্যকে ধূমপান ত্যাগের উপকরণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি বরং দীর্ঘমেয়াদে নিকোটিন নির্ভরতা বাড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে।

সংগঠনটির নেতারা জানান, বিশ্বজুড়ে বহু দেশ নিকোটিন পাউচকে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। বেলজিয়াম, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, ফ্রান্সসহ অন্তত ১১টি দেশে এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রায় ৩৪টি দেশ কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিকোটিন পাউচকে “তামাকজাত পণ্য” হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর প্রি-মার্কেট অনুমোদন বাধ্যতামূলক করেছে। 

যেসব দেশে নিয়ন্ত্রণ দুর্বল-সেসব দেশে এর ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। সুইডেন ও ডেনমার্কে এর ব্যবহার ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩-২৪ সালে ১০ম থেকে ১২তম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যবহার ৩.০ শতাংশ থেকে ৫.৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, আর ২১ বছরের নিচে ব্যবহার চারগুণ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটি তরুণদের নেশার নতুন মহামারি তৈরি করছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নিকোটিন পাউচের কোনো সক্রিয় বাজার নেই এবং ব্যবহারকারীও নেই।

টিসিআরসির সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার কোনো সিগারেট দোকান, সুপার শপ বা ফার্মেসিতে এ পণ্য পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ ব্যবসায়ী পণ্যটির নামই শোনেননি। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) কীসের ভিত্তিতে ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেডকে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন দিল—সে প্রশ্ন তোলেন বক্তারা। তারা জানান, মাত্র ৬৩ জনের কর্মসংস্থান এবং ৫১ কোটি টাকার বিনিয়োগের যুক্তি দেখিয়ে জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই অনুমোদনের ফলে ভবিষ্যতে নিকোটিন পাউচ বাজারে ঢোকার সুযোগ পাবে, যা তরুণদের নিকোটিনের দিকে ঠেলে দেবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করবে।

বক্তারা উল্লেখ করেন, এই অনুমোদন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার পাশাপাশি জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি ও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮(১)-এর লঙ্ঘন। তারা বলেন, একটি স্বাস্থ্য বিধ্বংসী পণ্যের অনুমোদন রাষ্ট্রীয় নীতি, আইন ও নৈতিকতার পরিপন্থী। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সরকারি অঙ্গীকারের সময়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেশার বিপদে ঠেলে দিতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়- বিশ্বে নিকোটিন পাউচ নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও কিছু দেশে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যেসব দেশে শুরুতে নিষিদ্ধ করা হয়নি, সেসব দেশে এর ব্যবহার কয়েক বছরের মধ্যেই উদ্বেগজনক স্তরে পৌঁছেছে। সুইডেনে প্রায় ৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এটি ব্যবহার করেন, ডেনমার্কে ব্যবহারকারী সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫৫ হাজার ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এটি তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত নিকোটিন পণ্য।

গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণদের মস্তিষ্কের বিকাশে নিকোটিনের নেতিবাচক প্রভাব মারাত্মক। মুখ বা মাড়ির ক্ষতি, উচ্চ রক্তচাপ, আসক্তি-এসব ঝুঁকিও রয়েছে।

টিসিআরসির গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে নিকোটিন পাউচের কোনো বাজার উপস্থিতি না থাকলেও তিনটি অনলাইন ই-কমার্স সাইটে সীমিত বিক্রি শুরু হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ বিপদের ইঙ্গিত দেয়। গবেষণা আরও দেখিয়েছে—ব্যবসায়ীরা পণ্যটি সম্পর্কে জানেন না, তাই এখনই নিষিদ্ধ না করা হলে ভবিষ্যতে তরুণরা সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।

সভায় বক্তারা বলেন, নিকোটিন পাউচ কোনো সাধারণ পণ্য নয়; এটি নতুন প্রজন্মকে আসক্তির এক নীরব স্রোতে ঠেলে দেবে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের সময় এমন একটি নীতিবিরোধী অনুমোদন পুরো জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এএইচ/এমআই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর