সোমবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ডিম কিনতে বেরিয়ে ফেরেনি, স্বামীর খোঁজে থানা-কারাগার শেষে গণকবরে স্ত্রী

একে সালমান
প্রকাশিত: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

S
স্বামীর খোঁজে রায়েরবাজার গণকবরের সামনে অপেক্ষায় জুলাই শহীদ রফিকুল ইসলামের স্ত্রী নার্জিয়া ইসলাম নুপুর। ছবি- ঢাকা মেইল

১৯ জুলাই। যাত্রাবাড়ীতে তীব্র আন্দোলন, বাসায় খাবার নেই। রাত আটটায় বাসা থেকে ডিম কিনতে বের হন রফিকুল ইসলাম। স্ত্রীকে বলে যান, মসজিদে এশার নামাজ শেষে ডিম কিনে বাসায় ফিরবেন। স্বামীর জন্য স্ত্রীর সেই অপেক্ষা আর শেষ হলো না।

‎ওইদিন রাতে অপেক্ষা করতে করতে পরদিন সকালে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কলেজ পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে ঘুরে স্বামীকে খুঁজতে থাকেন স্ত্রী নার্জিয়া ইসলাম নুপুর। থানা থেকে হাসপাতাল, এরপর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে স্বামীকে খুঁজেছেন তিনি।‎


বিজ্ঞাপন


‎অবশেষে রোববার (৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর রায়েরবাজার গণকবরে স্বামীর খোঁজে সন্তানদের নিয়ে এসেছেন নার্জিয়া ইসলাম।

‎তিনি জানান, আমরা যাত্রাবাড়ী গোলাপবাগ এলাকায় ভাড়া থাকি। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সারাদিন ঘরে তেমন খাবার ছিল না। আমার বাচ্চারা প্রায় না খেয়েই দিনপার করেছে। সন্ধ্যায় আমার স্বামী বাসায় এসে কোনো খাবার না দেখে বলে, তুমি ভাত বসাইয়া দাও, আমি এশার নামাজ শেষে ডিম নিয়ে বাসায় আসতেছি। সেই যে তিনি ডিম আনতে গেলেন, আজও ফেরেননি। 

নার্জিয়া ইসলাম জানান, আমার স্বামী একটা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার চালাতেন। তার আয় দিয়েই আমাদের সংসার আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চলতো। ‎আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর ঢাকায় এমন কোনো থানা নেই, যেখানে খুঁজতে যাইনি। প্রতিটি হাসপাতালও খুঁজেছি। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগার- সব জায়গায়ই খুঁজেছি। কোথায়ও পাইনি। 

তিনি জানান, এরপর গত বছরের ৯ আগস্ট আমার স্বামীকে খুঁজতে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে যাই। সেখানে গিয়ে দেয়ালে টাঙানো ছবি দেখে আমার স্বামীকে চিনতে পারি। এরপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, আমার স্বামীকে রায়েরবাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেওয়া হয়েছে।’


বিজ্ঞাপন


Salman2
স্বামীর খোঁজে রায়েরবাজার গণকবরের সামনে অপেক্ষায় জুলাই শহীদ রফিকুল ইসলামের স্ত্রী নার্জিয়া ইসলাম নুপুর। ছবি- ঢাকা মেইল

নার্জিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। সন্তানরাও তাদের বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গণকবরে আমার স্বামীর মরদেহ খুঁজতে ডিএনএর জন্য আবেদন করেছি। আমি অন্তত জানতে চাই, আমার স্বামী আমাকে আমার সন্তানদের ছেড়ে কোন দূরে চলে গেল। আমার স্বামীর কী দোষ, তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে হলো।

‎‎শহীদ রফিকুল ইসলামের ছেলে রাইয়ান ইসলাম বলেন, ‘আমি বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমেছিলাম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় তীব্র আন্দোলন চলছিল। বাবা সবসময় বাসায় থাকতে বলতো। আমি আন্দোলনে যাচ্ছি, কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে, ভয়ে সবসময় বাবা দুশ্চিন্তায় থাকতেন। কিছুক্ষণ পরপর আম্মুকে ফোন করে বাসায় আছি কি না খবর নিতো। হঠাৎ বাবা ডিম কিনতে বাইরে গিয়ে জীবনের তরে হারিয়ে গেল। আমাদের জন্য এখন কে দুশ্চিন্তা করবে? কে আমাদের খাবারের জন্য চিন্তা করবে?’ 

‎এই যুবক কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেন, ‘আমি কলেজে পড়তাম। বাবা আমাকে সবসময় ভালো করে পড়াশোনা করতে বলতো। আমি ওইদিনও আন্দোলন শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে পড়তে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা বাসায় এসে একটা নতুন শার্ট পরে আম্মুর সামনে এসে বলে, আমাকে দেখতে সুন্দর লাগে? আমরা বলছিলাম অনেক সুন্দর লাগে। আমাদের বলেছিল, নামাজ শেষ করে বাসায় ডিম নিয়ে ফিরবে। আন্দোলনে কোনো দোকনপাট খোলা নেই। বাসায় কোনো খাবার ছিল না। আম্মুকে ভাত বসিয়ে দিতে বলল। বাবা ওযু করে নামাজ পড়তে মসজিদে বের হলো। বাবা আর আমাদের কাছে ফিরে আসেনি।’

তিনি জানান, আমরা কত থানায়, হাসপাতালে ও কারাগারে খুঁজেছি। কোথাও বাবাকে খুঁজে পাই না। এরপর আমার এক কাকাকে নিয়ে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে গিয়ে বাবার রক্তাক্ত কাপড় আর চেহারা দেখে শনাক্ত করি। ততক্ষণে তারা আমার বাবাকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে দিয়েছে।’

বাবা হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে রাইয়ান ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি চাই, আমার বাবার মরদেহ শনাক্ত করে তার হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হোক। যারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখতে চাই আমরা।’

‎একেএস/এএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর