২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দফতরে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাযজ্ঞের দিন পিকআপে করে অনেক সৈনিক সদর দফতরে আসেন। বিডিআরের মহাপরিচালক যখন ফোনে সাহায্য চাচ্ছিলেন ওই সময় উত্তর দিক থেকে দরবার হলের পশ্চিম গেটে এসে দাঁড়ানো একটি পিকআপ থেকে অনেক সৈনিক অস্ত্রসহ নামেন। তাদের হিন্দি এবং ইংলিশে কথা বলতে শুনেছেন বলে স্ত্রীকে জানিয়েছেন বিডিআর কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমান। তারা অন্যান্য সৈনিকদের গুলি করার জন্য কমান্ড করছিলেন।
গত রোববার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
৩ নম্বর সাক্ষী বিডিআর কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমানের বরাতে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দিন দরবার হলে উপস্থিত ছিলেন পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমান। তিনি তার স্ত্রীকে দরবার হলের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন ডিজি যখন ফোনে সাহায্য চাচ্ছিলেন এরকম সময় উত্তর দিক থেকে একটি গাড়ি (পিকআপ) এসে দরবার হলের পশ্চিম গেটে দাঁড়ায়। ওই গাড়ি থেকে প্রচুর সৈনিক অস্ত্রসহ নামে। তিনি এইসব সৈনিকদের হিন্দিতে এবং ইংলিশে কথা বলতে শুনেছেন। তারা অন্যান্য সৈনিকদের গুলি করার জন্য কমান্ড করছিল। এ ছাড়া তিনি বাংলাতেও সৈনিকদের অফিসারদের উদ্দেশে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে শুনেছেন।
সিদ্দিকুর রহমান পরবর্তীতে তার স্ত্রীকে বলেছেন, ওই সৈনিকদের পোশাকেও অস্বাভাবিকতা ছিল। তিনি বলেছেন যে এগুলো দেখলে মনে হবে বিডিআরের পোশাক কিন্তু এগুলো আসলে বিডিআরের ছাপা না। সিদ্দিকুর রহমান যখন দরবার হল থেকে এগুলো দেখছিলেন তখন দুইজন সৈনিক তাকে ডাক দিয়ে অফিসারদের থেকে আলাদা করে। এরপর অস্ত্রের মুখে দুই হাত উঁচু করিয়ে তাকে পায়ে হাঁটিয়ে বাসায় দিয়ে যায়।
বিডিআর কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমামের দায়িত্ব পালন করা সিদ্দিকুর বাসায় আসার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং স্ত্রীকে ওই সময়ের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন তারা মসজিদে বৈঠক করছিল। আমি মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু আমাকে বের করে দিয়ে তারা কথা বলত। এখন বুঝতে পারছি কেন তারা এসব করতো।’
অফিসারদের স্টেজের ভেতর থেকে বেরোতে বলে বিদ্রোহীরা
৬৮ এবং ৬৪ নম্বর সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার পর দরবার হলের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীরা চিৎকার করে অফিসারদের স্টেজের ভেতর থেকে বের হতে বলতে থাকে। ১০টা ৩১ মিনিটের পরপরই স্টেজের পর্দার আড়ালে দক্ষিণ উইংয়ে থাকা তিনজন নারী অফিসারসহ বাকি অফিসাররা হাত উঁচু করে পর্দার বাইরে বের হয়ে আসেন। (১০টা ৩১ মিনিটে মেজর রুখসানা তার স্বামীকে মোবাইলে বিদ্রোহীদের দরবার হলে ঢুকে পড়ার কথা জানান, তিনি সময়টি পরবর্তীতে তার স্বামীর মোবাইল থেকে নিশ্চিত করেন।
৬৮ নম্বর সাক্ষী জানান, পর্দার ভেতর থেকে দেখা যায় বাইরে স্টেজের নিচে ১৫-১৬ জন বিদ্রোহী কাপড়ে মুখ ঢেকে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্রোহীরা প্রথমেই যেসব অফিসার বের হয়ে আসেন তাদের সবার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। সবাইকে মাটিতে শুয়ে পড়তে এবং র্যাংক খুলে ফেলতে বলে।
অফিসাররা দরবার হলের খালি ফ্লোরে এবং কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়েন। তখন দরবার হলের ভেতরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মুখে কাপড় বাঁধা একজন বিডিআর সৈনিক তাদের ওপর ৩/৪ রাউন্ড গুলি চালায়। ওই গুলিতে লে. কর্নেল কায়সার (একিউ কনস্ট্রাকশন) ও অপর দুইজন অফিসার গুলিবিদ্ধ হন। লে. কর্নেল কায়সার গুলি লেগে উপুড় অবস্থা থেকে চিৎ হয়ে যান। (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৪)।
মেজর রুখসানা দেখেন তার বামপাশে লে. কর্নেল কায়সারের গায়ে গুলি লেগেছে এবং রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তখন সময় আনুমানিক ১০টা ৩৫ মিনিট। সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৮।
৬৪ নম্বর সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, মেজর জাহিদ এবং দুইজন অফিসার উঠে লে. কর্নেল কায়সারকে উঁচু করে দরবার হলের দক্ষিণের মেইন দরজার বাইরে নিয়ে আসেন। বাইরে ডিজির গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। গাড়ির কাঁচ ও ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ভাঙা ছিল। তারা ডিজির গাড়ির কাছে যাবার আগেই বাইরে থেকে একজন মুখবাঁধা বিদ্রোহী দৌড়ে এসে অস্ত্র ধরে বাধা দেয়। মেজর জাহিদ তাকে অনুরোধ করেন যে কর্নেল কায়সারকে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সে বলে ‘কেউ কোথাও যাবে না। এখানেই মরবে। তোরা দরবার হলের ভিতরে যা।’ লে. কর্নেল কায়সারকে বাইরে রেখে ওই তিনজন অফিসার পুনরায় ভেতরে প্রবেশ করেন। লে. কর্নেল কায়সারের মুখ তখনও নড়ছিল।
৬৮ নম্বর সাক্ষীর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, লে. কর্নেল কায়সার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দরবার হলের ভেতরে মহিলা অফিসারদের দিকে এক জওয়ান দৌড়ে এসে বলে ‘মহিলা ম্যাডামদের মারিসনে, ওনারা ডাক্তার।’ ফলে অন্য একজন সৈনিক তাদেরকে দরবার হলের পশ্চিম দিকের গেটের দিকে নিয়ে যায়। তাদের পেছনে পেছনে অন্য অফিসাররাও আসতে থাকেন।
মেজর জাহিদ, লে. কর্নেল কায়সারকে বাইরে রেখে আসার পর ভেতরে ঢুকে দুইজন অফিসারকে দরবার হলের মেঝেতে শোয়া অবস্থায় দেখতে পান এবং আরও দেখেন অন্যান্যদের এক লাইনে সারিবদ্ধভাবে পেছনের পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে বাইরে নেওয়া হচ্ছে। তাকেও ওই লাইনে দাঁড়াতে বলে। তখন কর্নেল এলাহীও তাদের সঙ্গে ছিলেন। লাইনে মেজর জাহিদের সামনে ছিলেন ডিএএজি মেজর সালেহ। সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৪।
দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় মেজর সালেহের পেটে গুলি লাগে। মেজর রুখসানা দেখেন মেজর সালেহের ইউনিফর্ম খোলা। পেটের কাছে গেঞ্জি তোলা এবং পেটে গুলির ছিদ্র রয়েছে। তখন সময় আনুমানিক ১০টা ৪৫মিনিট। সূত্র: সাক্ষী নম্বর ৬৮।
৪২ নম্বর সাক্ষীর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরবার হল থেকে বের হওয়ার পরই আর একদল অস্ত্রধারী স্কুলের কাছে থেকে দৌড়ে আসে এবং চিৎকার করতে থাকে ‘অফিসারদের শেষ কর’। ছাই রংয়ের সিভিল শার্ট পরা একজন বলে ‘ওদের একজনকেও ছাড়ব না, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলব, বাঁধো সবাইকে।’ গায়ে গুলি লাগার ভয়ে লে. কর্নেল ইয়াসমিন মাটিতে শুয়ে পড়েন। অস্ত্রধারীরা এসে তাদেরকে রাইফেলের বাট, বেয়নেট ও বুট দিয়ে মারতে থাকে। এক সময় বিদ্রোহীরা পুরুষ অফিসারদের চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে। মহিলা পুরুষ সবাইকে লাইনে দাঁড় করায় এবং রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত হয় গুলি করার জন্য। এই পর্যায়ে মেজর জাহিদ চোখের বাঁধন খুললে একজন সৈনিক তাকে লাথি মারে। তিনি কর্নেল ইয়াসমিনের গায়ের ওপর পড়েন, তারা অন্য লেডি অফিসারসহ মাটিতে পড়ে যান।
তখন একজন পেছন থেকে বলে ‘আর মারিসনা।’ তারপর তাদেরকে উঠতে বলে। মহিলারা উঠে দাঁড়াতেই রাইফেলধারী বিদ্রোহীটি তাদেরকে সামনের নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুলে চলে যেতে বলে। মেজর রুখসানা লোকটির হাত ধরে বলেন ‘আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন।’ তখন একটি পিকআপ তাদের সামনে আসতেই লোকটি গাড়িটি থামায়। পিকআপটি ছিল ছাই রংয়ের, তবে বিডিআরের। লোকটি তাদেরকে পিকআপে উঠতে বলে। ভেতরে মুখ-ঢাকা তিনজন অস্ত্রধারী বিদ্রোহী বসা ছিল। তারা প্রথমে নিতে রাজি হয়নি। তখন তাদেরকে বোঝানো হয় ডাক্তারদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। মহিলা ডাক্তাররা গাড়িতে উঠে দেখতে পান তিন বাক্স গুলি মেঝেতে রাখা। লে. কর্নেল লুৎফর রহমান খান গাড়িতে উঠতে চাইলে তাকে উঠতে দেওয়া হয়নি। গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয়। মেজর রুখসানা দেখেন লে. কর্নেল কাজী রবি কোন রকমে গাড়ির সঙ্গে ঝুলছেন। সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৮।

৬৪ নম্বর সাক্ষীর বরাতে বলা হয়, মেজর জাহিদ একটি গুলির আওয়াজের পর শোয়া অবস্থায় শুনতে পান যে, একজন বলছে, ‘ও মরেনি।’ তখন রাইফেলের বাট দিয়ে তার চোয়ালে খুব জোরে আঘাত করে এবং তার মুখ দিয়ে প্রচণ্ড বেগে রক্ত বের হতে থাকে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চোখের কাপড় খুলে দেখতে পান যে, মহিলা ডাক্তারদের পিকআপের পেছনে উঠানো হয়েছে, সঙ্গে আরও একজন অফিসার এবং পিকআপ ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে মেজর মিজানকে (জিএসও-২, প্রশিক্ষণ) দৌড়ে পিকআপে উঠতে দেখেন। মেজর জাহিদের মুখ দিয়ে তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তিনি জিহ্বা দিয়ে বুঝতে পারছিলেন যে, নিচের দাঁতের মাঝখানে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে (তাঁর নিচের চোয়ালের হাড় ভেঙে গিয়েছিল)। ইতোমধ্যে মুখ বাঁধা একজন সিপাহী দৌড়ে এসে মেজর জাহিদকে ঝাপটে ধরে এবং বলে ‘এ স্যারকে চিনি, উনাকে মারিস না।’ এরপর উক্ত সৈনিক মেজর জাহিদকে চোখ বেঁধে হাঁটিয়ে আনুমানিক ৫০-৬০ গজ দূরে একটা ঘরে নিয়ে যায়। পরে চোখ খুলে দিলে তিনি দেখেন একটা গার্ড রুমের বাথরুম এবং সেটা ছিল হাজারিবাগ ৫ নং গেটের গার্ডরুম। হাতের ঘড়িতে তিনি দেখেন তখন সময় ১০টা ৪৫ মিনিট।
একটি পিকআপে মহিলা ডাক্তারদের উঠানো হলে কর্নেল রবি, লে. কর্নেল লুৎফর এবং মেজর জায়েদ উঠার চেষ্টা করেন কিন্তু তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। পিকআপটি লে. কর্নেল ইয়াসমিন, মেজর রুখসানা ও মেজর ফারজানাকে নিয়ে দরবার হলের পশ্চিম প্রান্ত থেকে রওয়ানা দেয়। সেটি প্রথমে নিকটবর্তী ৫নং গেটে যায়। কিন্তু গেটের অস্ত্রধারী সৈনিকরা তা ফিরিয়ে দেয়। এমনকি ৫নং গেটের বাইরে অবস্থানরত কিছু সিভিল পোশাকের লোক হৈ-চৈ করে ওঠে যাতে ওই অফিসারদের বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া না হয়। পিকআপটি তখন ৩নং গেটের দিকে রওয়ানা হয়। পিকআপটি ৩নং গেটের কাছে এলে কয়েকজন সৈনিক পিক-আপটিকে হাসপাতালে যেতে বলে। অবশেষে পিকআপটি হাসপাতালে আসে এবং মহিলা অফিসারদের অপারেশন থিয়েটারের সামনে নামিয়ে দেয়। সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৪২।
এমআর

